শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জান্নাতের পথ দেখায় ভালো বন্ধু

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

জান্নাতের পথ দেখায় ভালো বন্ধু

প্রাচীন মিসরের গল্প বলছি। তখন মিসরে চলছিল ফেরাউনি শাসন। ফেরাউনের দোর্দ- প্রতাপে প্রজারা তাকে প্রভুর আসনে বসিয়ে পূজা করত। ফেরাউন স্পষ্টভাবে বলেছিল, ‘আমিই তোমাদের সবচেয়ে বড় প্রভু।’ সূরা নাজিয়াত, আয়াত ২৪। আল্লাহর নবী মুসা (আ.) ফেরাউনকে ক্ষমতার দম্ভ ছেড়ে আল্লাহর পথে আসার উপদেশ দিতেন। একদিন মুসা (আ.) বললেন, ফেরাউন! তুমি আমার একটি কথা শোনো। বিনিময়ে তোমাকে চারটি পুরস্কার দেওয়া হবে। ফেরাউন বলল, এ তো বড়ই আনন্দের কথা। একটি কথা মানলে চারটি পুরস্কার! বল তোমার সেই কথাটি কী? মুসা (আ.) বললেন, তুমি বল, আল্লাহই আসমান ও জমিনের একমাত্র স্রষ্টা। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনিই সবার রিজিকদাতা। ফেরাউন বলল, যদি তোমার কথা মেনে নিই, তাহলে কোন চারটি পুরস্কার আমাকে দেওয়া হবে। মুসা (আ.) বললেন, আল্লাহর ওপর ইমানের বিনিময়ে যে চারটি অমূল্য সম্পদ তোমাকে দেওয়া হবে তার প্রথমটি হলো স্থায়ী সুস্থতা। চিকিৎসাশাস্ত্রে যেসব রোগশোকের কথা বলা হয়েছে তা তোমার শরীর থেকে চিরদিনের জন্য দূর হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, তুমি লাভ করবে দীর্ঘায়ু, সুখী জীবন। ফেরাউনের যেন আর তর সয় না। সে জানতে চায়, তোমার তৃতীয় পুরস্কার সম্পর্কে বল। মুসা (আ.) বললেন, তৃতীয় পুরস্কার হলো, দুই জাহানের বাদশাহি। ইহজগতের রাজত্ব তুমি পাবে। পরকালের রাজত্বও তোমার হাতের মুঠোয় দেওয়া হবে। এই রাজত্বের সুবিধা হলো, সেখানে তোমার কোনো শত্রু থাকবে না, প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকবে না। তুমি ভেবে দেখ, আল্লাহর কত বড় নাফরমানি করছ তুমি। তবু তিনি তোমাকে অগাধ ধনরতœ ও নিয়ামত দিয়েছেন। এখন যদি তাঁর হুকুম মেনে চল, তাহলে কত অবারিত নিয়ামত তোমাকে দেওয়া হবে। ফেরাউন বলল, মুসা! তোমার চতুর্থ পুরস্কার কী? মুসা (আ.) বললেন, তুমি যদি আল্লাহকে প্রভু মেনে নাও তাহলে তুমি চিরতারুণ্য লাভ করবে। দেহমনে তুমি হয়ে উঠবে একজন সত্যিকারের তরুণ। এ তারুণ্য কখনই মরে যাবে না। মুসার কথা শুনে ফেরাউন ভাবল, মুসার কথাগুলো মিথ্যা নয়। আমাকে এ সম্পর্কে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। ফেরাউন তার সহধর্মিণী আসিয়াকে এ সম্পর্কে বলল। আসিয়া পরামর্শ দিলেন, যত তাড়াতাড়ি পারো তুমি মুসার প্রভুর ওপর বিশ্বাস স্থাপন কর। আসিয়া আরও বললেন, এমন সুন্দর প্রস্তাব তো ওই মজলিসেই তোমার মেনে নেওয়া উচিত ছিল। আসিয়ার এমন উৎসাহ-উদ্দীপনায়ও ফেরাউনের মন গলেনি। সে বলল, বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রী হামানের সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি। আসিয়া নিষেধ করলেন, সাবধান! হামানকে তুমি এ বিষয়ে কিছু বোলো না। সে তোমাকে অবশ্যই বিভ্রান্ত করবে। তবু ফেরাউন হামানকে বলে। পরামর্শ চায় মুসার প্রভুর ওপর ইমান আনার ব্যাপারে। হামান বলল, জাহাঁপনা! মুসার মিষ্টি কথার ফাঁদে আপনি পা দেবেন না। মুসা আপনাকে যে চারটি পুরস্কারের কথা বলেছে, ওগুলো যদি পাল্লায় ওজন করেন, তাহলে জনগণ যেভাবে আপনাকে পূজা-অর্চনা করে তার এক দিনের সমানও হবে না। শেষ পর্যন্ত হামান ফেরাউনকে রাজকীয় পদ ধরে থাকার পরামর্শ দিল এবং ফেরাউন ধ্বংস হয়ে চিরজাহান্নামি হয়ে গেল। মুসা (আ.)-এর বাণী, স্ত্রী আসিয়ার উৎসাহ সত্ত্বেও ফেরাউন সত্য ও সুন্দরকে মেনে নেয়নি। কারণ, তার ছিল এক দুষ্ট বন্ধু হামান। ফেরাউন নিজে দুষ্ট। হামানও দুষ্ট। মাওলানা রুমি তার মসনবিতে বলেন, দুষ্টই দুষ্টকে টানে। ভালো টানে ভালোকে। তা না হলে মুসা ও আসিয়ার মতো নেককারদের কথা কেন ফেরাউন মেনে নিল না? কেন হামানের এক কথাতেই ফেরাউন বশ মানল? এর একটাই কারণ, সৃষ্টির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো, সে যেমন তার বন্ধুত্বও হয় তেমন প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে। তার জীবন পরিচালিত হয় তার বন্ধুদের প্রভাবে। তাই কেউ যদি দুষ্ট হয়, তার বন্ধুও জুটবে দুষ্ট প্রকৃতির। আর কেউ যদি ভালো হয়, তার জীবনেও ভালো বন্ধুর সমাহার ঘটবে। এ ঘটনা বলার পর দুনিয়ার মানুষকে নসিহতের সুরে মওলানা রুমি বলেন, হে মানুষ! চিন্তা করে দেখ, ফেরাউনের মতো কোনো দুষ্টকে তোমার বন্ধু-পরামর্শক বানিয়ে ফেলনি তো? তাহলে কিন্তু মুসার ভালো উপদেশ আর আসিয়ার উৎসাহ-উদ্দীপনা তোমার জীবনকে আলোকিত করতে পারবে না। অতএব, ভালো বন্ধু বানাও। সে তোমাকে জান্নাতের পথ বাতলে দেবে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাস্সিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর