শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপির জাতীয় সরকারের লাড্ডু

সৈয়দ বোরহান কবীর

বিএনপির জাতীয় সরকারের লাড্ডু

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আরও প্রায় দুই বছর। সংবিধান অনুযায়ী ২০২৩-এর ডিসেম্বর অথবা ২০২৪-এর জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এখনই দেশে মৃদুমন্দ নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তার সঙ্গে কালবৈশাখীর মতো নানা ষড়যন্ত্র ডালপালা বিস্তার লাভ করছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন কিছুদিন সরগরম ছিল। ইতোমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন কমিশন মতবিনিময় করছে। এর মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে খুব চ্যালেঞ্জিং হবে, সে বার্তাটা পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ আগ্রহী। বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর হয়ে গেল। এ উপলক্ষে অংশীদারির সংলাপে অংশ নিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন। সেখানে খুশিতে আত্মহারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর কৃতজ্ঞতার ঝুড়ি মেলে ধরেছিলেন। ভাগ্যিস মার্কিন সংস্কৃতিতে ‘কদমবুসি’ ব্যাপারটা নেই। থাকলে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘রাষ্ট্রহীনকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য’ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্ঘাত কদমবুসি করে বসতেন। কদমবুসি না করলেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে মুরুব্বি মেনেই এসেছেন। ওই দ্বিপক্ষীয় সংলাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক হয় তেমন প্রত্যাশা করা হয়েছে। কেবল অংশগ্রহণমূলক নয়, অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রচ্ছন্নভাবে ইঙ্গিত করেছে বিএনপি যেন নির্বাচনে আসে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধিমান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত ছিলেন দীর্ঘদিন। কাজেই তাদের ইশারা ইঙ্গিত ভালোই বোঝেন। আর সেজন্যই বিএনপিকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সঁপে দিয়েছেন। বিএনপি যেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় সে ব্যাপারে মার্কিন হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ নিয়ে দেশে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতারাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু আমি মনে করি একদিক থেকে ড. মোমেন সঠিক কাজই করেছেন। এটা মনে হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট। ৭৪ পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন না বিএনপির পুস্তিকা তা বুঝতে আমার খানিকটা কষ্টই হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওই প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তা বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের অনুরণন। বিএনপি নেতাদের মুখে প্রায়ই শুনি দেশে গণতন্ত্র নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য নয় ইত্যাদি। মার্কিন প্রতিবেদনে এসব বক্তব্যকে সংকলিত ও সত্যায়িত করা হয়েছে। কাজেই বিএনপিকে নির্বাচনে নেওয়া না নেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে আগামীতে ভূমিকা রাখবে, মানবাধিকার রিপোর্ট তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক করার তাগিদ এখনই দিচ্ছে।

বিএনপি অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে নতুন সুরে কথা বলছে। ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করলেও এখন বিএনপি আবার ২০১৩ সালের অবস্থানে ফিরে গেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া তারা (বিএনপি) কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। বিএনপির এ দাবি পুরনো এবং পরিত্যক্ত। ইতোমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই মৃত ঘোষিত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে বিগত দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেরাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছে। সেই বিএনপি আবার কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন আছে। মাতামাতি নেই। বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। বিএনপির কয়েকটি সাবেক শরিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপরীতে জাতীয় সরকারের দাবি তুলে রাজনীতির শান্ত মাঠে একটু উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে। প্রথমে গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ, এরপর একে একে জেএসডির আ স ম আবদুর রবসহ কয়েকজন জাতীয় সরকারের দাবি তোলেন। ডা. জাফরুল্লাহ এবং অন্যদের জাতীয় সরকারের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে প্রায় খেয়ে ফেলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্ব ও সুশীলদের মধ্যেও আগ্রহ সৃষ্টি করে। অনেকেই বলতে থাকেন, এটা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী সমঝোতা ফরমুলা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সমঝোতা প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা মূলত একটি নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার। শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে থাকা সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বশীল একটি নির্বাচনকালীন সরকারের সমঝোতা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বিএনপি অবশ্য তখন এত অসহায় ও এতিম ছিল না। জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল। নেতৃত্বে বেগম জিয়া। এর ওপর বোনাস ছিল পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বিপুল বিজয়। বিএনপির অনেক নেতাই তখন ক্ষমতার সুবাস পাচ্ছিলেন। এ সময় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে। সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা তীব্র হয়। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর মতো বর্বর ঘটনা ঘটে।

পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করেন। গণভবনে চায়ের দাওয়াত দেন। এর জবাবে বেগম জিয়া যা বলেছেন সেই অডিও জাতি শুনেছে। বেগম জিয়ার ওই বক্তব্য ছিল রাজনৈতিক শিষ্টাচারবিবর্জিত। আজ যদি ফিরোজায় নিভৃতে বেগম জিয়া টেলি আলাপটি আবার শোনেন তাহলে নিশ্চয়ই নিজেই লজ্জা পাবেন। যাই হোক, সে সময় সহিংসতা ও অশান্তি থেকে দেশকে রক্ষার জন্য শেখ হাসিনা উদার এবং সাহসী এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদের দলগুলোর আসনভিত্তিক আনুপাতিকহারে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও বিরোধীদের হাতে তুলে দেওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বেগম জিয়া ওই সমঝোতা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কেন? বিএনপির নেতারাও এখনো সেই ‘কেন’র উত্তর পাননি। বিএনপি মনে করেছিল তারা নির্বাচন বয়কট করলেই এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সংসদ টিকবে না। যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি সেবার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করেছিল। কিন্তু ওই সংসদের আয়ু ছিল মাত্র আড়াই দিন। যেহেতু ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। সংসদ ছিল ক্ষণস্থায়ী। তাই বিএনপি মনে করেছিল ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হবে না। সংসদ টিকবে না। কিন্তু এটি ছিল বিএনপির ‘ঐতিহাসিক ভুল’। ইতিহাসে কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি একইভাবে হয় না। সে ভুলের মাশুল এখনো তিল তিল করে দিতে হচ্ছে দলটিকে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যদি বিএনপি জাতীয় সরকারের দাবি মানত তাহলে এটি আমাদের তিক্ত নির্বাচনব্যবস্থায় একটি নতুন রীতি হতো। নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার গঠিত হবে। এই জাতীয় সরকার নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু বিএনপি ২০১৩ সালেই সে সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছে। এখন যখন বিএনপির শুভাকাক্সক্ষীরা জাতীয় সরকারের দাবি তুলছেন তখন তা কিছুটা হলেও আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো মনে করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর দলীয় সরকারের মাঝামাঝি জাতীয় সরকার একটি সমঝোতার জায়গা। যদিও আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে এখনো স্বীকৃতিই দেয়নি। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। বর্তমান সরকারের অধীনে। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রথমে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলো। বিএনপির মধ্যে কয়েকজন ডা. জাফরুল্লাহকে একহাত নিলেন। তাঁরা জানিয়ে দিলেন জাতীয় সরকার নয়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। একটি রাজনৈতিক দল যে কোনো দাবি উত্থাপন করতেই পারে। বিপুল জনমত তৈরি করে সে দাবি আদায়ও করতে পারে। কিন্তু কদিন পর আবার বিভ্রান্তি। বিএনপি নেতারা ফিসফিস করে জাতীয় সরকারের কথা বলতে শুরু করলেন। আমরা একটু অবাক হলাম। তাহলে বিএনপি কি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এলো? বিএনপি কি তাহলে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়? না, অল্প দিনের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব বিস্ময় জাগানিয়া এক ফরমুলা হাজির করলেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন। এ ফরমুলা আবিষ্কারের পর বিএনপি নেতারা আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলেন। কেউ কেউ বললেন ষড়যন্ত্রকারীরা চুপসে গেছে।

বিএনপির এ নতুন ফরমুলা সুদূরপ্রসারী এবং অনেক ‘যদি’, ‘কিন্তু’র ওপর নির্ভরশীল। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। ১৩ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা একটি দলকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য করবে। আওয়ামী লীগ বিএনপি নেতাদের প্রেস ক্লাব ও রিপোর্টার্স ইউনিটিতে দেওয়া বক্তব্যে প্রচন্ড ভয় পাবে। ভয়ে সন্ত্রস্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির দাবি মেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় আবার ফেরত যাবে। এখানে বিএনপি আন্দোলন করবে সব রাজনৈতিক দল নিয়ে। আওয়ামী লীগবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট করবে বিএনপি। এ আন্দোলনে যারা থাকবে নির্বাচনের পর তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে বিএনপি। অর্থাৎ এমন একটা নির্বাচন হবে যে নির্বাচনে বিএনপি ও তার শরিকদের ছাড়া আর কোনো দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিশ্চিত জয়ের পর জাতীয় সরকার। কি অদ্ভুত উর্বর মস্তিষ্কের চিন্তা। এ রকম একটি সরকার গঠিত হতে হলে সংসদে আওয়ামী লীগকে আসনশূন্য থাকতে হবে। কারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একটি আসন পেলে তাকেও জাতীয় সরকারের হিসসা দিতে হবে। অর্থাৎ বিএনপির ফরমুলা বাস্তবায়ন করতে হলে আওয়ামী লীগকে নিঃস্ব, রিক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক ফরমুলা তৈরি করা হয় রাজনীতির বাস্তবতা মাথায় রেখে। তেমনি রাজনৈতিক লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয় অর্জন-সক্ষমতার নিরিখে। আকাশকুসুম ও অবাস্তব রাজনৈতিক লক্ষ্য একটি রাজনৈতিক দলে হতাশা বাড়ায়। দলের কর্মীদের হতোদ্যম করে। অলীক কল্পনার জায়গা রাজনীতিতে নেই। কিন্তু বিএনপির জাতীয় সরকারের কল্পনা রূপকথাকেও হার মানায়। ২০১৩ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি যা করতে পারেনি এখন ফখরুল তা করবেন কীভাবে?

বিএনপি নেতারাও জানেন তাদের ‘জাতীয় সরকার’ ভাবনা অবাস্তব। কিন্তু বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল এ রকম আকাশকুসুম ভাবনা কেন রাজনীতির মাঠে ছড়াচ্ছে? এর কারণ খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে বিএনপির দেউলিয়াত্ব ও অগ্রহণযোগ্যতা। অথবা বিএনপিকে দিয়ে কেউ জাতীয় সরকারের লাড্ডু বাজারে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার কথা বলছে। কিন্তু বিএনপির ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কোনো রাজনৈতিক দলই। নির্বাচনের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কার্যত মৃত। বিএনপির আদর্শিক জোট ২০ দল নিষ্ক্রিয়। দীর্ঘদিন ধরে ২০ দলের কোনো কার্যক্রম নেই। আন্দালিব রহমান পার্থর বিজেপির মতো বেশ কয়েকটি দল ২০ দল থেকে বেরিয়ে গেছে বহু আগে। জামায়াত অনেকটা বিএনপির পরকীয়া। জামায়াতকে নিয়ে প্রকাশ্যে চললে বিএনপির বদনাম হয়। লোকলজ্জার ভয়ে জামায়াতকে নিয়ে প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে পারছে না বিএনপি। আবার প্রেম এত প্রগাঢ় যে ত্যাগও করতে পারছে না। জামায়াতের সঙ্গে মাখামাখি নিয়ে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র আপত্তি রয়েছে। বিএনপি নেতারাও তা ভালো করে জানেন। বিএনপির অস্তিত্ব ও জাতীয় রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতার জন্য তার কিছু সঙ্গী দরকার। যেমন ২০১৮-তে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন, কেউ বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে রাজি নয়। জোট করতে চায় না। এই তো কদিন আগে বাম জোট হরতাল ডাকল। বিএনপি এ হরতাল সমর্থন করল। কিন্তু বাম জোট জানিয়ে দিল তারা বিএনপির সমর্থন চায় না। এ প্রত্যাখ্যান বিএনপির জন্য একটি শিক্ষা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিপুল জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপি কতটা অপাঙ্ক্তেয় ও গুরুত্বহীন তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। বাম দলগুলো যেমন বিএনপিকে দক্ষিণপন্থি, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তি মনে করে, তেমনি হেফাজত, খেলাফতের মতো দলগুলোও বিএনপিকে বিশ্বাসঘাতক ও সুবিধাবাদী মনে করে।

বিএনপির প্রতি কিছুটা সমর্থন আছে ব্যক্তিনির্ভর সাইনবোর্ডসর্বস্ব কিছু রাজনৈতিক দলের। এক নেতার এক দল জাতীয় হাতে গোনা কয়েকটি দল বিএনপির চারপাশে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু এসব দলের নেতারা ড্রয়িংরুম রাজনীতিতে অভ্যস্ত। তাঁদের জনভিত্তি নেই। এঁরা আবার ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চান। বিএনপির পেটে গিয়ে বর্তমানের সুযোগ-সুবিধা খোয়াতে চান না। এঁদের জন্যই লোভাতুর লাড্ডুর ব্যবস্থা করেছে বিএনপি। এ লাড্ডুর নাম জাতীয় সরকার। বিএনপি মনে করছে একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে সরকার- এ সেøাগানে সব রাজনৈতিক দল হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সরকার পতনের আন্দোলনে শামিল হবে। কিন্তু বিএনপি বুঝতে পারেনি তাদের নিজের অবস্থাই এখন সঙ্গিন। এ রকম মৃতপ্রায় একটি সংগঠনের সঙ্গে মন্ত্রী হওয়ার লোভে আন্দোলনের ঝুঁকি নেওয়ার দল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে বিএনপির সংকট হলো নেতার। বেগম জিয়া এখন বিএনপির নেতৃত্বে কার্যত নেই। তারেক জিয়াও লন্ডনে পলাতক। এ পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বহীন বিএনপি। ২০১৮-তে বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে নেতা হিসেবে ভাড়া করেছিল। এবারও নেতার সন্ধানে বিএনপি। এজন্য জাতীয় সরকারের মুলা দিয়ে বিএনপি একজন জুতসই নেতা খুঁজছে। আর নিঃসঙ্গতা কাটাতে সঙ্গীর জন্য দিচ্ছে ‘আকর্ষণীয় অফার’। কিন্তু জাতীয় সরকারের হিসাব-নিকাশ এত সরল না-ও হতে পারে। ওয়ান-ইলেভেনের মতো নতুন কোনো নাটকের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে জাতীয় সরকারের আওয়াজ তুলে। প্রধানমন্ত্রী বুধবার বলেছেন, ‘সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র চলছে।’ বিরাজনীতিকরণের লক্ষ্যে সে ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ‘জাতীয় সরকার’ তত্ত্ব কি না তা-ও ভেবে দেখা দরকার। তা না হলে বিএনপির জাতীয় সরকারের লাড্ডুতে সুশীলদের লোভাতুর চোখ কেন?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর