মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজনীতির পালাগান, পালাগানের রাজনীতি

মহিউদ্দিন খান মোহন

রাজনীতির পালাগান, পালাগানের রাজনীতি

আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অন্যতম বাহন পালাগান। এ পালাগান আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক। একসময় পালাগানের ছিল জয়জয়কার। শীত মৌসুমে গ্রামগঞ্জে পালাগানের আসর বসত। সে সময় পালাগানের শিল্পীদের কদর ছিল বেজায়। আয়োজকরা কয়েক মাস আগেই শিল্পীদের বায়না করে রাখতেন। পালাগানের বৈশিষ্ট্য ছিল, এ গান হতো দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতা। বিশাল প্যান্ডেলের নিচে শিল্পীরা কথা ও সুরের যুদ্ধে নামতেন। দর্শক-শ্রোতাও যেতেন দুই ভাগ হয়ে। নিজেদের পছন্দের শিল্পীকে তারা করতালি দিয়ে উৎসাহ দিতেন। শিল্পীরা গান গাইতে গাইতে একপর্যায়ে একে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অশ্লীল-অশ্রাব্য গালিও দিতেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, একটু আগে মঞ্চে যাদের ‘হাতে পেলে ছিঁড়ে খাব’ অবস্থা ছিল, বিরতির সময় তাদের দেখা যেত হাসিমুখে খোশগল্প করতে, চা পান করতে। খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ান, মাখন দেওয়ান, হাজেরা বিবি, আবুল সরকার, পরেশ আলি দেওয়ান, আলেয়া বেগম, আকলিমা বেগম ছিলেন পালাগানের তারকা শিল্পী। বর্তমানে আমাদের জাতীয় সংসদ সদস্য মমতাজও একসময় পালাগানের নামকরা শিল্পী ছিলেন। তাঁর বাবা মধু বয়াতিও পালাগান গাইতেন। কালের বিবর্তনে পালাগানের সেই রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। আধুনিকতা আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এনেছে। সময়কে আমরা এতটাই মূল্য দিই যে, পালাগান শোনার জন্য পুরো একটা রাত ‘নষ্ট’ করতে আগ্রহী হই না। তার চেয়ে ঘরে বসে মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের বোতাম টিপে মুহূর্তে দুনিয়ার তাবৎ বিষয়বস্তুর দর্শন-শ্রবণই বেহতর মনে করি।

আমার অত্যন্ত ¯ন্ডেœহভাজন মোতাহার হোসেন পালাগানের এক সমঝদার শ্রোতা। গ্রামে থাকতে সে নিজের গ্রাম কল্লিগাঁওসহ আশপাশের যেখানেই পালাগান হতো সেখানেই ছুটে যেত। এখন আর যায় না। তবে ঢাকার নবাবপুরে ওর দোকানে গেলে প্রায়ই দেখি মোবাইল ফোনে ইউটিউবে পুরনো পালাগান শুনছে। একদিন সে খুব আক্ষেপ করছিল পালাগান আগের মতো হয় না বলে। আমি ওকে বললাম, কেন আমি তো প্রতিদিন পালাগান শুনি। অবাক নেত্রে তাকিয়ে সে বলল, কী যা তা বলছেন! লেখালেখি আর বইপড়া ছাড়া আর কিছুতে আপনার আগ্রহ আছে? আর পালাগানই বা এই সময়ে আপনি পাবেন কোথায়? বললাম, পালাগান এখন টেলিভিশনে দেখি-শুনি, পত্রিকায় পড়ি। কিছু বুঝতে না পেরে মোতাহার আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বললাম, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তা কি তোমার পালাগানের মতো মনে হয় না? এই যে প্রতিদিন তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে কখনো শ্রাব্য, কখনো অশ্রাব্য ভাষায় বাক্যগোলা নিক্ষেপ করে চলেছেন, এ ধরনের কথা পালাগানের শিল্পীরা একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য বলে থাকেন। মোতাহার মাথা নেড়ে সহমত পোষণ করল। রাজনৈতিক নেতারা একে অন্যকে কুপোকাৎ করতে বাক্যবাণে জর্জরিত করবেন এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। তবে যেহেতু রাজনৈতিক কথাবার্তা, বক্তৃতা-বিবৃতিতে সেন্সরশিপ আরোপের কর্তৃপক্ষ নেই, তাই যিনি বলেন তাকেই ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করতে হয়। অর্থাৎ তাকে স্মরণে রাখতে হয়, যে কথাটি আমি বলব, তা যেন শালীনতার সীমা অতিক্রম না করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনৈতিক মঞ্চের গায়েনরা সে সম্পর্কে যেন একেবারেই উদাসীন। তারা এমন সব কথা মাঝেমধ্যে বলেন, তাতে তাদের সম্পর্কেই মানুষের ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হয়। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা পরস্পরকে এমন ভাষায় আক্রমণ করেন, যা শুনলে অনেক সময় কানে আঙুল দেওয়ার উপক্রম হয়। পাশাপাশি তারা যে কোনো বিষয়ে প্রতিপক্ষের ওপরে দোষ চাপাতে সব সময় তৎপর থাকেন। কদিন আগে পঞ্চগড়ে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের একটি জলসায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। সে ঘটনা কেন্দ্র করে এখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি লিপ্ত হয়েছে রাজনৈতিক বচসায়। ১৪ মার্চের দৈনিক পত্রিকাগুলোয় এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে উন্মত্ত বিএনপি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে সন্ত্রাসী পন্থায় সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছে। বিএনপি নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা ও বিবৃতিতে প্রমাণিত হয় সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড়ে সংঘটিত আহমদীয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় তারা জড়িত।’ অন্যদিকে মির্জা আলমগীর বলেছেন, ‘এ সরকার গোয়েন্দা বাহিনী ব্যবহার করে বিএনপির বিরুদ্ধে যত রকমের অপপ্রচার চালানো যায় তা করে যাচ্ছে। পঞ্চগড়ের এ ঘটনার সঙ্গে এ সরকার সরাসরি জড়িত।’ এর আগে ১২ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব বলেছিলেন, ‘বিএনপির চলমান আন্দোলন ভিন্ন খাতে নিতেই সরকার পরিকল্পিতভাবে পঞ্চগড়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়েছে।’ একই দিন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার কয়েকটি এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর দোকানপাট পরিদর্শন শেষে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পঞ্চগড়ে হামলা বিএনপির পরিকল্পনার অংশ।’ একই বিষয়ে দুই প্রধান দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এই পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে সংগত কারণেই। কেননা আহমদীয়া ইস্যুটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং এটা নিয়ে আগে-পরে অনেক দুঃখজনক ঘটনাই ঘটেছে। লক্ষণীয় হলো, ঘটনাটি সম্পর্কে যেসব খবরাখবর এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে এসেছে, তার কোথাও সরকার বা বিএনপির যোগসূত্রের উল্লেখ পাওয়া যাযনি। ঘটনাটি ঘটেছে স্থানীয় মুসল্লিদের একটি অংশের দ্বারা। এ ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা প্ররোচনা ছিল, এমন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। ঘটনাটি জানতে পঞ্চগড়ে ফোন করেছিলাম সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট রীনা পারভীনকে। বিএনপির এই নেত্রী বললেন, এটা স্পর্শকাতর একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে সংঘটিত। কতিপয় অতি উৎসাহী মানুষের সাময়িক উত্তেজনার ফসল; যা অত্যন্ত দুঃখজনক। হামলার ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের মধ্যে হয়তো বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই দলের লোকজনই ছিল। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা দোষ চাপাচ্ছেন বিএনপির ওপর। আমাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের একজনকেও ধরা হচ্ছে না। আর ঘটনার জন্য বিএনপিকে দোষারোপ করা কতটা যুক্তিযুক্ত আপনারাই বলুন। বললাম, আপনাদের মহাসচিবও তো সে দৌড়ে পিছিয়ে নেই। তিনিও তো ঘটনার সঙ্গে সরকারের ‘পরিকল্পনা’ আবিষ্কার করে ফেলেছেন। রীনা পারভীন একটু ইতস্তত করছিলেন। তার অবস্থা অনুধাবন করে বললাম, বুঝতে পারছি প্রসঙ্গটি আপনার জন্য ‘স্পর্শকাতর’। তবে যা বোঝার বুঝেছি।

আমাদের দেশে অবশ্য এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। একটি ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অভিসন্ধি থেকেই দলগুলো এ ধরনের বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তবে তারা এটা খেয়াল রাখেন না যে, রাজনৈতিক ‘লাভের গুড়’ পাতে তুলতে গিয়ে তাদের ভাবমূর্তির হাঁড়িতে পিঁপড়া ঢুকে পড়ছে। এ ধরনের তথ্য-প্রমাণহীন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ যে জনমনে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি করছে তা খেয়াল করার ফুরসত বোধকরি তাদের নেই। আর সেজন্যই পঞ্চগড়ের অরাজনৈতিক ঘটনাকে রাজনৈতিক রং চড়ানোর কসরত করছেন উভয় দলের নেতারা।

রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র বাক্যবাণ নিক্ষেপ করবেন, এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। কথা ওঠে তখনই, যখন তারা পরস্পরকে আক্রমণ করতে গিয়ে শ্রদ্ধাবোধের বিষয়টি বিস্মৃত হন। আমাদের যারা প্রাতঃস্মরণীয় রাজনীতিবিদ, তারা সমালোচনা করতে গিয়ে কখনই প্রতিপক্ষের নেতা সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করেননি। কারণ তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। রাজনৈতিক নীতি-আদর্শের ভিন্নতা সেই শ্রদ্ধবোধে এতটুকু চির ধরাতে পারেনি। আগে নেতারা সমালোচনার ক্ষেত্রে নাম উচ্চারণ না করার সংস্কৃতি মেনে চলতেন। এখন তার ধারেকাছেও ঘেঁষেন না তারা। বরং কে কত কদর্য ভাষায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে পারলেন সেটাকেই বিজয়ের মাপকাঠি বিবেচনা করেন। রাজনীতিতে ‘আনপার্লামেন্টারি ওয়ার্ড’ বা ‘অসংসদীয় শব্দ’ বলে একটি কথা আছে। এর অর্থ এমন কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলো পার্লামেন্টে বা রাজনীতিতে ব্যবহার করা যায় না। পার্লামেন্টে অবশ্য এর প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে স্পিকারের ‘এক্সপাঞ্জ’ ক্ষমতা ব্যবহার করে। কিন্তু রাজনীতির মেঠো বক্তৃতায় এর প্রতিবিধানের উপায় কী? এর একমাত্র উপায় সেলফ সেন্সরশিপ; যে কথা আগেই বলেছি। এই আন পার্লামেন্টারি শব্দগুলোর মধ্যে ‘চোর’ একটি। কাউকে প্রকাশ্যে চোর বলে অভিহিত করা মোটেই শোভনীয় নয়, অন্যায়ও বটে। কিন্তু আজকাল রাজনীতিকরা একে অন্যকে অবলীলায় চোর আখ্যায়িত করে এক ধরনের অপরিণামদর্শী আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। অতি সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিই। গত ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের এক বৈঠকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেছেন, ‘ফখরুল সাহেব, ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার কারা করেছে? ভোট চুরির অপবাদ আওয়ামী লীগকে দেবেন না। ভোট চুরির মহারাজা বিএনপি।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ মার্চ ২০২৩)। এর জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরদিন যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের এক সভায় বলেছেন, ‘আসলে আওয়ামী লীগ হলো চোর। সব ক্ষেত্রে তারা চুরি করে। তাদের চেয়ে বড় চোর বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ মার্চ ২০২৩)। এই হলো আমাদের বর্তমান শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকদের ভাষা। ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় বিএনপি চোর, আর মির্জা আলমগীরের ভাষায় আওয়ামী লীগ চোর। তাদের কথা অনুযায়ী উভয়েই চোর। এর দ্বারা কি তারা জনসমক্ষে নিজেদের হেয় প্রতিপন্ন করছেন না?

অনেক দিন আগে এক মাহফিলে প্রখ্যাত ওয়ায়েজিন মাওলানা হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী একটি গল্প বলেছিলেন। দুই মৌলভি একসঙ্গে সফর করে যাচ্ছিলেন। খুব ক্লান্ত। দুপুরবেলা এক ভদ্রলোক তাদের তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বললেন, হুজুর আমার এখানে খাওয়াদাওয়া করেন। হুজুরেরা বললেন, আমরা গোসল করব। এক হুজুর গোসল করতে পুকুরঘাটে গেলে ভদ্রলোক আরেক হুজুরকে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর আপনি বড় নাকি ওই হুজুর বড়? তিনি বললেন, আরে ওইটা তো একটা গরু। এবার দ্বিতীয়জন গোসল করতে গেলে বাড়ির মালিক প্রথমজনকে একই কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আরে ওইটা তো একটা ছাগল। এরপর তারা পরিপাটি হয়ে খেতে বসলেন। তাদের সামনে কিছু কচুরিপানা ও ঘাস এনে রাখা হলো। তা দেখেই চটে গেলেন দুই হুজুর। চিৎকার করে বললেন, এই ফাজলামোর অর্থ কী? কচুরিপানা ঘাস মানুষে খায়? বাড়ির কর্তা জবাব দিলেন, কী করব হুজুর। আপনি তাকে বলেছেন গরু, আর তিনি আপনাকে বলেছেন ছাগল। আমাদের দেশে গরুতে খায় কচুরিপানা, আর ছাগলে খায় ঘাস। এখন নাক ডুবাইয়া খান। তখন দুই হুজুর হাতে হাত মিলিয়ে বলে, বোঝছসনি। আর কেউ কারও বদনাম করিস না। তাইলে ঘাস খাইয়া মরণ লাগব। মোরগের রান আর কপালে জুটব না। গল্পটি এখানেই শেষ। এর মর্মার্থ ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। কেননা আকেলমান্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর