অবশেষে আমার পক্ষে আলাস্কা ভ্রমণ সম্ভব হলো। ইতিপূর্বে আমেরিকায় এসে দুই দফা সিদ্ধান্ত নিয়েও এ বয়সে সেখানে গিয়ে সুস্থ শরীরে ফিরে আসার বিষয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠায় সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয়েছিল। কিন্তু এবার গ্রীষ্ম থাকায় মনে সাহস জুগিয়ে সেখানে গিয়ে কয়েকটা দিন কাটিয়ে এসেছি। আলাস্কা হলো আমেরিকার সর্ববৃহৎ রাজ্য, যার আয়তন ৬ লাখ ৬৩ হাজার ২৬৮ বর্গমাইল বা ১৭ লাখ ১৭ হাজার ৮৫৬ বর্গকিলোমিটার এবং সেখানকার বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ৭ লাখ ৩৬ হাজার ৮১ জন। উত্তর আমেরিকার সর্ব-উত্তরে অবস্থিত বরফের রাজ্য আলাস্কাকে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত বলা হয়। উল্লেখ্য, রুশ সাম্রাজ্যের অংশ থেকে আমেরিকা আলাস্কা রাজ্যটি ক্রয় করে। ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ মাত্র ৭২ লাখ ডলারে আলাস্কা বিক্রির প্রস্তাবে আমেরিকা রাজি হলে, ১৮ অক্টোবর ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকার কাছে রাজ্যটি হস্তান্তর করে। কথিত আছে, রাশিয়া-ইংল্যান্ড যুদ্ধ হলে আলাস্কা ব্রিটিশদের দ্বারা আক্রান্ত হবে এই ভয়ে রাশিয়া আমেরিকার কাছে এলাকাটি বিক্রি করে দিয়েছিল। কারণ সে সময় আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার সুসম্পর্ক ছিল। অন্যদিকে ব্রিটেন-ফ্রান্স এবং অটোম্যানদের সঙ্গে ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত সংঘটিত ক্রাইমিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের কারণে রাশিয়ার মনে এক ধরনের ভয় ঢুকে গিয়েছিল যে, ব্রিটেন যদি আলাস্কা দখল করে নেয় তাহলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের প্রভাব এবং কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাবে। অতএব ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে আলাস্কা হারানোর চেয়ে আমেরিকার কাছে রাজ্যটি বিক্রি করে দেওয়াই ভালো। তা ছাড়া রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে আলাস্কা অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় এবং সে সময় মাত্র ৪০০ জন রুশ নাগরিক সেখানে বসবাসরত থাকায় আলাস্কা সম্পর্কে রাশিয়ার আগ্রহও কম ছিল। আর এভাবেই আলাস্কা রাজ্যটি রাশিয়া বিক্রি করে দেওয়ায় উত্তর আমেরিকায় রাশিয়ার অস্তিত্ব শেষ হয় এবং সেই সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের সর্ব উত্তরে আমেরিকার প্রবেশপথ তৈরি হয়। আলাস্কা ক্রয়ের পর প্রথম দিকে আমেরিকাও সেখানে তেমন কোনো মনোযোগ দেয়নি। বরং তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিওয়ার্ড আলাস্কা ক্রয়ে উৎসাহ প্রকাশ করায় অনেকে সেটাকে বোকামি বলে সমালোচনা করেছিল! কিন্তু অল্প দিনেই প্রমাণিত হয় যে আলাস্কা প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটি এলাকা। ১৮৯৬ সালে সেখানে স্বর্ণের খনি মেলে; তা ছাড়া আলাস্কায় আমেরিকার চতুর্থ বৃহৎ তেল মজুতসহ সর্ববৃহৎ জিঙ্ক মজুতেরও সন্ধান পাওয়া যায়। ক্রয়ের পর প্রথমে আলাস্কা আমেরিকার একটি অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৫৯ সালে তা ৪৯তম রাজ্যের স্বীকৃতি লাভ করায় অ্যাঙ্কারেজকে রাজধানী ঘোষণা করা হয়।
আমি টেক্সাস থেকে আলাস্কার রাজধানী অ্যাঙ্কারেজে পৌঁছে একটি হোটেলে উঠেই টালকিটনা ভ্রমণের জন্য আলাস্কা রেলওয়ের ডেনালি স্টার রেল সার্ভিসের টিকিট ক্রয় করে পরদিন ভোরে সেই ট্রেনে চেপে টালকিটনা পৌঁছাই। এ ট্রেনে চলার পথের দুপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য ভোলার মতো নয়! ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য মনভোলানো প্রাকৃতিক সেসব দৃশ্য যে কোনো মানুষের মনকেই রোমাঞ্চিত করে তুলবে! এক পাশে পাহাড় অন্য পাশে নদী, লেক, সাগরের মতো বিশাল জলরাশি দেখতে দেখতে ছোট শহর টালকিটনা পৌঁছে দেখি, আগ থেকেই সেখানে লোকে লোকারণ্য! কারণ টালকিটনা হলো বিশাল বিশাল পর্বতবেষ্টিত পার্বত্য এলাকা ডেনালির প্রবেশ-দ্বার। পাহাড় থেকে নেমে আসা ডেনালি নদীর আকর্ষণসহ পর্বতের চূড়ায় উঠে গ্লেসিয়ারে হাঁটাচলা, পাহাড়ি নদীতে র্যাফটিং, পাহাড়ের গ্লেসিয়ারে হাইকিং ইত্যাদির জন্য পর্যটকরা এখানে ভিড় জমান এবং এখানকার ট্যুরিস্ট অফিস থেকে টিকিট ক্রয় করে র্যাফটিং, হাইকিং ইত্যাদিতে বেরিয়ে পড়েন। আমার পক্ষে র্যাফটিং, হাইকিং করা সম্ভব নয় বিধায় আমি পাহাড়ের চূড়ায় বরফের রাজ্যে পৌঁছার জন্য ৩০০ ডলারের একটি টিকিট কেটে ছোট্ট একটি বিমানে চেপে বসি! আমাদের ৯ জন যাত্রীকে নিয়ে বিমানের পাইলট ডেনালির সুউচ্চ পাহাড়ের পার্শ্বদেশ এবং খাঁজে খাঁজে ঘুরে অত্যন্ত কাছ থেকে পাহাড়ের গায়ে জমাটবাঁধা বরফরাশি দেখানো শুরু করলে এক অকল্পনীয় এবং মোহনীয় দৃশ্যে আমরা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি! যেন বিমানের জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই পাহাড়ের গায়ের বরফ ছোঁয়া যাবে এমন একটা অনুভূতি নিয়ে আমরা এক ঘণ্টা পাহাড়ের খাঁজ এবং ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়ালাম! এভাবে পাহাড়ের পর পাহাড়ের পার্শ্বদেশ (খাঁজ) এবং ওপরে জমাটবাঁধা বরফ দেখতে দেখতে একসময় বিমানটি একটি পাহাড়ের সমতল এলাকায় (যে এলাকাটি পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করা ছিল) বিমানটি অবতরণ করলে আমরা তা থেকে নেমে পড়ি। আমাদের যেহেতু আগে থেকেই বরফের ওপর দিয়ে হাঁটাচলা করার উপযোগী জুতা পরানো হয়েছিল, সুতরাং আমরা সবাই বরফের ওপর চলাফেরা শুরু করলাম। সেখানে নামার পর দেখলাম যত দূর চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ! এভাবে ১৫-২০ মিনিট সময় বরফের ওপর চলাফেরা, ফটো ওঠানো ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন হলে পূনরায় আমরা বিমানে চেপে যথাস্থানে পৌঁছে এক অপার আনন্দময় অনুভূতি নিয়ে ফিরতি ট্রেনে চেপে বসি।
আলাস্কার উত্তরের অংশ ভ্রমণের পর অতঃপর দক্ষিণের অংশ অর্থাৎ সাগরের দিকটাও আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু স্থানাভাবে সেসব স্থান ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ এখানে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। দক্ষিণাঞ্চলের সিওয়ার্ড পর্যন্ত আলাস্কা রেলরোডের যে সার্ভিস, সেই ট্রেনের যাত্রীগণ বোটিংসহ অন্যান্য কিছু Activities সম্পন্ন করতে অ্যাঙ্কারেজ থেকে সিওয়ার্ড যাত্রা করে থাকেন। আর আমিও একদিন সেই ট্রেনের যাত্রী হিসেবে বিরল অভিজ্ঞতা এবং বিমল আনন্দ অনুভব করেছি! দক্ষিণাঞ্চলের এই রেলভ্রমণও অত্যন্ত রোমাঞ্চকর! কারণ এই অঞ্চল ভ্রমণের সময়ও ট্রেনের জানালা দিয়ে কাছ থেকে পাহাড়ের চূড়ায় এবং খাঁজে জমাটবাঁধা বরফ দেখা যায়! তা ছাড়া এ সময় আমি জঙ্গলের ভিতর হতে বের হওয়া কালো ভালুক এবং অতঃপর দুটি বাচ্চাসহ একটি ভালুক পরিবারের চলাচলের কিছু দৃশ্যও দেখতে পেয়েছিলাম!
আলাস্কা রাজ্যটি যেহেতু অনেক বড় একটি পাহাড়ি এবং সামুদ্রিক এলাকা, সুতরাং অল্প কয়েক দিনে তা ঘুরেফিরে দেখা সম্ভব নয়। যেমন সমুদ্র ভ্রমণের জন্য কমপক্ষে সাত দিনের একটি সিক্রুজ নিতে হয়, যা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবু স্থলভাগের নদনদী, লেক, পাহাড়পর্বত, জঙ্গল-জলাশয় যতদূর যা দেখেছি তাতেই আমার প্রাণ জুড়িয়েছে! এ বয়সে যেহেতু গৃহত্যাগ করে টানা দীর্ঘদিন ভ্রমণে খাওয়াদাওয়া, ওষুধ সেবন ইত্যাদিতে বড়সড় একটা বিঘ্নের সৃষ্টি হয়, অতএব সমুদ্রভ্রমণ বাদ রেখে আমাকে আলাস্কার পাহাড়পর্বত, নদনদী, লেক, জঙ্গল-জলাশয় দেখেই ফিরে আসতে হয়েছে এবং আমি তাতেই সন্তুষ্ট ।
আলাস্কা ভ্রমণের বিভিন্ন স্তরে দেখতে পেলাম, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট এই ভূখণ্ডে আজ এখনো কয়েক মাইল পরপর দুই-একটি বাড়ি, যেখানে আবার পাঁচ-সাতজনের বেশি বসতি নেই! আমাদের দেশের চেয়ে ৪ গুণ বড় এই রাজ্যে কোটি কোটি একর সমতল বসবাসযোগ্য পতিত জমি পড়ে থাকা সত্ত্বেও এখানে মনুষ্য বসতির বড়ই অভাব! অথচ এখানে মনুষ্য বসবাসের খুব একটা প্রতিকূল পরিবেশ তেমনটিও নয়। অ্যাঙ্কারেজসহ কিছু এলাকায় দিনরাতে ২২ ঘণ্টাই সূর্যালোক থাকে। যদিও শীতকালে কোনো কোনো অঞ্চল বসবাসের জন্য ভীষণ প্রতিকূল!
আলাস্কার ৭ লাখ মানুষের প্রায় ৩ লাখ শুধু রাজধানী অ্যাঙ্কারেজে বসবাস করে। বাদবাকি ৪ লাখ মানুষ সারা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পাহাড়পর্বত বাদ দিলেও এখানে বসবাসযোগ্য প্রচুর এলাকা বা জমি আছে, অথচ যেসব স্থানেও কোনো জনবসতি বা আবাদ নেই! এ অবস্থায় কোনো আমেরিকান যদি আলাস্কায় বসবাস করতে আগ্রহী হন বা যারা বসবাসরত আছেন আলাস্কা সরকার কর্তৃক তাদের বার্ষিক একটি নগদ অর্থ প্রদান করা হয়, বয়সভেদে যার পরিমাণ ১ থেকে ৩ হাজার ডলার পর্যন্ত।
চলাফেরার পথে আমার সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত একজন আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারের আলাপ-পরিচয় হলে তিনি জানালেন, নিউইয়র্ক শহরে তার বাড়ি ছিল, কিন্তু অবসরগ্রহণের পর তিনি সে বাড়ি বিক্রি করে আলাস্কার ঈগল সিটিতে এসে বসবাস করছেন। ঈগল সিটি আলাস্কার ঈগল নদীতীরের ছোট্ট একটি শহর, যেখানে মাত্র শখানেক লোকের বসবাস। অথচ এখানে সব প্রকার নাগরিক সুযোগসুবিধা বিদ্যমান, এমনকি একটিবারও আছে। নিউইয়র্ক থেকে ঈগল সিটিতে সেটেলড্ অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক আমাকে আরও জানালেন, সেখানকার শান্তস্নিগ্ধ আবহাওয়ায় তিনি তার স্ত্রী, কন্যা এবং তিনজন নাতিনাতনি নিয়ে অনেক সুখে আছেন।
আলাস্কার প্রাকৃতিক সম্পদের কথা বলতে গেলে সেখানকার অফুরন্ত বনজ সম্পদ, সোনার খনি, তেলের খনি, জিঙ্কের মজুত ইত্যাদি সম্পদের কথা বলতে হয়! তা ছাড়া এখানকার সামুদ্রিক সম্পদের পরিসংখ্যান আরও বিস্ময়কর! সারা আমেরিকার চাহিদার অর্ধেক মৎস্যসম্পদের জোগানদাতা হচ্ছে আলাস্কা! সবশেষে বলতে চাই, আমেরিকার মতো বিশাল একটি দেশ, যে দেশে আলাস্কার মতো জনবিরল রাজ্য আছে, সারা পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষ ঢুকিয়ে দিলেও যে দেশে বাংলাদেশের মতো জনঘনত্বের সৃষ্টি হবে না, সেই দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইমিগ্রেশন আইনের কঠোরতা প্রয়োগের নামে যা করছেন তা কতটা মানানসই বা যুক্তিসংগত আশা করি সে বিষয়টিও আমেরিকার আইনপ্রণেতারা বিবেচনা করে দেখবেন!
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা