শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

সুবর্ণা যেভাবে অভিনয়ে...

সুবর্ণা যেভাবে অভিনয়ে...

বিটিভির সোনালি যুগের অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। নাটকের অভিনেত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় তকমাটি তার ক্ষেত্রে ব্যবহার করলে মনে হয় ভুল হবে না। বাবা বিখ্যাত অভিনেতা-আবৃত্তিকার গোলাম মুস্তাফা। সেই হিসেবে বলাই যায়, যোগ্য বাবার যোগ্য কন্যা তিনি। একাধারে তিনি নির্মাতা, আবৃত্তিশিল্পী, উপস্থাপক ও সংসদ সদস্য। নন্দিত এই অভিনেত্রী সব মাধ্যমেই দ্যুতি ছড়িয়েছেন এবং এখনো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। এই চির অনন্যাকে নিয়ে আয়োজন সাজিয়েছেন- পান্থ আফজাল

 

তিনি অনন্যা, তিনি সুবর্ণা

সুবর্ণা মুস্তাফা চির অনন্যা, একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সোনালি সময় থেকে এই পর্যন্ত যত অভিনেত্রী রয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী তিনি। তার নামটাই যেন একটি ব্র্যান্ড। বিনোদনের সব ক্ষেত্রেই রয়েছে তার পদচারণা। তিনি একাধারে একজন নির্মাতা, আবৃত্তিশিল্পী, উপস্থাপক ও সংসদ সদস্য। ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়ে লাক্স সাবানের মডেল হয়েছিলেন সুবর্ণা। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ গোলাম মুস্তাফার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সুবর্ণাকে ‘গোলাম মুস্তাফা আবৃত্তি পদক’-এ ভূষিত করে।

 

সুবর্ণার জীবনে যারা...

সুবর্ণা মুস্তাফার জন্ম ১৯৫৯ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকায়। বাবা গুণী অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বিবাহিত জীবনে তিনি প্রথমে অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদিকে বিয়ে করেন। ২০০৮ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং পরে তিনি নাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদকে বিয়ে করেন।

সব্যসাচী অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা

জনপ্রিয় অভিনেতা ও বিশিষ্ট আবৃত্তিকার গোলাম মুস্তাফা। জন্ম ২ মার্চ ১৯৩৫ সাল। পিতার নাম মৌলবি মো. ইসমাইল। ছাত্র জীবন থেকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। গোলাম মুস্তাফা তার অভিনয় শুরু করেন বিডি হাবীবুল্লাহ রচিত ‘পল্লীমঙ্গল’ মঞ্চনাটকের মাধ্যমে ১৯৪৫ সালে। একই বছর ‘টিপু সুলতান’ নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হন। তার প্রথম বেতার নাটক প্রচারিত হয় ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৬-৫৭ সালে বড় ভাই এ কে এম মুসার সরকারি প্রচারচিত্র ‘ওয়ান এরর অব ল্যান্ড’-এ অভিনীত ছবিটি ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। তিনি ঢাকা টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে নাটকে অভিনয় শুরু করেন। গোলাম মুস্তাফা অভিনয় করেছেন দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে। ১৯৬০ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে জমিদারের ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করেন এই সব্যসাচী অভিনেতা। প্রথম ছবি থেকেই তিনি খল চরিত্রের একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হারানো দিন’ ছবিতে মদ্যপ জমিদারের ভূমিকায় তার অভিনয়ের কথা অনেকের স্মৃতিতে এখনো অমলিন। প্রথমদিকে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বেশ কটি নাটকে নায়ক চরিত্রে ছিলেন। তিনি বাংলা ও উর্দু মিলে প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে নায়ক, সহনায়ক, খলনায়কসহ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন। তবে অভিনয় জীবনে খলনায়ক হিসেবেই বেশি সফল হয়েছিলেন। তিনি আবৃত্তিকার হিসেবেও দুই বাংলায় ছিলেন নন্দিত। তিনি কল্পবিজ্ঞান, গল্প এবং চলচ্চিত্র বিষয়ক বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। বেতার ও টিভিতে তার রচিত বেশ কিছু নাটক প্রচার হয়। তিনি ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পদকে ভূষিত হন। তার স্ত্রীর নাম হোসনে আরা বিজু। এক মেয়ে সুবর্ণা মুস্তাফা যেমন অভিনয় জগতে দ্যুতি ছড়িয়েছেন, অন্যদিকে আরেক মেয়ে ক্যামেলিয়া মুস্তাফা টুকটাক অভিনয় করলেও কখনো নিয়মিত হননি। তবে জামাতা হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রের একজন ভার্সেটাইল অভিনেতা। গোলাম মুস্তাফা ২০০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

 

একজন ক্যামেলিয়া মুস্তাফা

কন্যা ক্যামেলিয়ার জন্মের পর স্ত্রী হোসনে আরা বিজুর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যায় দেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালামের। পরে তাকে বিয়ে করেন প্রখ্যাত অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা। তাই ক্যামেলিয়া মুস্তাফা মূলত শামসুদ্দীন আবুল কালামের মেয়ে, গোলাম মুস্তাফার নন। ক্যামেলিয়া কিছু দিন অভিনয় জগতে থাকলেও একদা পাড়ি জমান বিদেশ বিভুঁইয়ে, বাবার পথ ধরে।

অভিনয়ের সুবর্ণ নক্ষত্র সুবর্ণা

অভিনয়ের এক সুবর্ণ নক্ষত্র সুবর্ণা মুস্তাফা। তার চেহারায় বাঙালি রমণীর শাশ্বত সৌন্দর্যের মৌন রূপ স্পষ্ট এবং স্মিত আবেদন ও রহস্যময় ঘরানার সৌন্দর্য তার সামগ্রিক সৌন্দর্যকে প্রায় ক্ল্যাসিক রূপ দিয়েছে। অভিনয় ক্যারিয়ারে রয়েছে তার কেবলই সফলতার গল্প। অভিনেত্রীদের মধ্যে একটি প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সুবর্ণা। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় টেলিভিশনে প্রথম অভিনয় করেন। তবে নাটকে অভিনয় শুরু তারও আগে। পাকিস্তান রেডিওতে প্রযোজক হিসেবে কাজ করতেন তার মা। মায়ের হাত ধরে যেতে যেতে পাঁচ অথবা ছয় বছর বয়সে বেতারে নাটক করেন। ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত তিনি নিয়মিত শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করতেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে ‘বরফ গলা নদী’তে অভিনয় দিয়ে টেলিভিশনে আবার তার যাত্রা শুরু হয়। সুবর্ণা বলেন, ‘আমার সব কিছুই প্রায় একসঙ্গে হয়েছে। টেলিভিশনে নাটক, ঢাকা থিয়েটারে সেলিম আল-দীনের নাটক ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’-এ অভিনয় আর তার বছরখানেকের মধ্যে ঘুড্ডি চলচ্চিত্রে কাজ।’ তিনি অভিনয় প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার আসলে অভিনয় করেই ভালো লাগে, মাধ্যম যেটাই হোক। তবে আনন্দ দিয়েছে সবচেয়ে বেশি টেলিভিশন। টেলিভিশনে আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ার। তিন থেকে চার ক্যামেরার সামনে কাজ করেছি। আর কাজ শিখেছি মঞ্চে; বুঝেছি চরিত্র কীভাবে নির্মাণ করতে হয়। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ হলো বেতারে। একজন অভিনেতার আল্টিমেট লক্ষ্য সিনেমা। আমি শটকার্টে কোনো কাজ করতে পারি না। শতভাগ দিয়ে কাজ করি।’

 

অভিমানে মঞ্চ ত্যাগ... একটানা ২৫ বছর তিনি কাজ করেছেন মঞ্চে। ঢাকা থিয়েটারে সুবর্ণা মুস্তাফার অভিনীত অনেক চরিত্র এখনো অনেকের মনে দাগ কেটে আছে। সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, ‘আমি থিয়েটার করা শিখেছি নাসিরউদ্দীন ইউসুফের হাত ধরে। কিন্তু একটা সময় কাজ করতে করতে মনে হচ্ছিল, আমার আরেকটু অ্যাডভেঞ্চারাস হওয়া দরকার। এক সময় মনে হলো, আর না করি। অনেক সময় অনেক প্রিয় জিনিস, প্রিয় মানুষের স্মৃতি সুন্দর রাখার জন্য বা সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য দূরে সরে যাওয়া ভালো। তবে অনেকে বলেন, অভিমান করে সুবর্ণা মঞ্চ ছেড়েছেন।

 

মুনা নামে যিনি সপ্রতিভ

৮০’র দশকে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বিশেষ করে আফজাল হোসেন এবং হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে তার জুটি ব্যাপক দর্শক সমাদর লাভ করে। তিনি হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে মুনা চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক পরিচিতি পান। যেই মুনা ছিলেন বিখ্যাত চরিত্র বাকের ভাই (আসাদুজ্জামান নূর)-এর প্রেমিকা। এখনো সবাই তার সেই ‘মুনা’ চরিত্রটি মনে রেখেছে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির পরে তার মৃতদেহ বহন করতে আসেনি কেউই; এসেছিল শুধু মুনা। তথাকথিত কোনো সম্পর্ক তাদের মাঝে না থাকলেও বাকের ভাইয়ের নিথর, প্রাণহীন দেহের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে কেঁদে যাচ্ছিল মুনা। সেখানে ছিল না আর কেউ। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের শেষ পর্বে টেলিভিশন পর্দায় কাঁদছিলেন মুনারূপে সুবর্ণা আর তার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদছিল দেশের হাজারো দর্শক।

শুধু নিজের অভিনয় দিয়ে মুনার বেদনায় তিনি পুরো দেশবাসীকে সমব্যথী করে তুলেছিলেন। এ ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ ও ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ‘বারো রকম মানুষ’-এ অভিনয় করেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।

 

চলচ্চিত্রে অনবদ্য

সুবর্ণা নিয়মিত গড়পড়তা চলচ্চিত্রে কখনো অভিনয় করেননি। জীবনঘনিষ্ঠ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। মূলধারার কিছু ছবিতেও তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। তবে অনেকের মতে, টিভি পর্দায় তিনি যতটা ভরাট ও আকর্ষণীয়, চলচ্চিত্রের পর্দায় অতটা নন। ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ দিয়ে তিনি চলচ্চিত্র জগতে আসেন। ১৯৮৩ সালে ‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান। পরের বছর ‘নয়নের আলো’ ছবিতে নায়ক জাফর ইকবালের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় সব শ্রেণির দর্শককে নাড়া দিয়েছিল। অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে কমান্ডার, অপহরণ, লাল সবুজের পালা, সুরুজ মিয়া, শঙ্খনীল কারাগার, পালাবি কোথায়, আঁখি ও তার বন্ধুরা, গহীন বালুচর ও সর্বশেষ চলচ্চিত্র গন্ডী। রুপালি পর্দায় যথেষ্ট সাফল্য পেলেও সুবর্ণা নিয়মিত হননি।

 

সুবর্ণা বনাম আফজাল-ফরীদি

আফজাল-সুবর্ণা জুটি ছিলেন সোনালি সময়ের নাটকের উত্তম সুচিত্রা। এই জুটির রসায়ন নিয়ে দর্শকদের মধ্যে ছিল দারুণ উত্তেজনা। তাদের জুটির জনপ্রিয়তা এখনো মানুষকে নস্টালজিক করে তোলে। এমনকি এ মুহূর্তেও আফজাল-সুবর্ণা জুটি নিয়ে নাটক তৈরি হয় এবং সেটিতে আগের প্রজন্মের দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের দর্শকদেরও আগ্রহ লক্ষ করা যায়। রক্তের আঙুর লতা, পারলে না রুমকি নাটকে এই জুটির রসায়ন আজো দর্শকদের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। দর্শকদের মধ্যে বিশেষ করে সুবর্ণা আর আফজাল হোসেনকে ঘিরে প্রেমের অনেক গল্প শোনা যেত। রাইসুল ইসলাম আসাদকে ঘিরেও ছিল এমন গুঞ্জন। পরবর্তীতে সেটা মোড় নেয় হুমায়ুন ফরীদির দিকে। সুবর্ণা বলেন, ‘আমি সব সময়ই এটা এনজয় করেছি। তখনো করেছি, এখনো। আমাকে, আফজাল এবং ফরীদিÑএই তিনজনকে ত্রিরতœ বলা হতো। আফজাল এবং আমার মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। আফজালের সঙ্গে, নূর ভাইর সঙ্গে আমার জনপ্রিয় অনেক নাটক আছে। ফরীদির সঙ্গে অনেক ভালো কাজ আছে।’ এরপর তো ফরীদিকে তিনি বিয়েও করেন। দীর্ঘ ২২ বছর সংসার করার পর ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর