বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিনেমা নিয়ে অভিনব যত প্রচারণা

১৯৬৭ সালে ‘শহীদ তিতুমীর’ ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবির প্রতি দর্শক নজর কাড়তে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রচার চালায় এই বলে যে, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় আগুন লাগলে দর্শকরা চাইলেই তা নেভাতে পারবেন। এমন কথা শুনে অনেক দর্শক বালতি ভর্তি দুধ নিয়ে সিনেমা হলে যায় এবং ছবিতে বাঁশের কেল্লায় আগুন লাগলেই সিনেমা হলের পর্দায় দর্শকরা দুধ ঢেলে দিত...

আলাউদ্দীন মাজিদ

সিনেমা নিয়ে অভিনব যত প্রচারণা

‘জ্বীন সিনেমা একা দেখতে পারলেই লাখ টাকা পুরস্কার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের এক ওয়ার্কশপে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে ছাত্রদের উদ্দেশে ঘোষণা দেওয়া হলো, কেউ একা একটি হলে বসে জ্বীন সিনেমাটি সম্পূর্ণ দেখতে পারলে, তাকে ১ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সেখানে কেউ রাজি হয়নি। আপনি কী পারবেন জ্বীন সিনেমাটি একা দেখতে, সম্পূর্ণ হলে আপনি একা? যদি পারেন তাহলে জানান। আমরা রেডি -আবদুল আজিজ (চেয়ারম্যান জাজ মাল্টিমিডিয়া)। বি. দ্র. ১. ভয়ের কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জাজ মাল্টিমিডিয়া বা হল কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। ২. হলের বাইরে একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকবে। ৩. যদি সম্পূর্ণ সিনেমা না দেখতে পারেন, তাহলে আপনাকে হলের ভাড়া ও অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিতে হবে। ৪. যদি সম্পূর্ণ সিনেমা দেখতে পারেন, আপনাকে কিছুই দিতে হবে না, জাজ মাল্টিমিডিয়া আপনাকে নগদ ১ লাখ টাকা দেবে, এবং কোক-নাশতা খাওয়াবে বা দিয়ে দিবে।’ ঈদে মুক্তি পাচ্ছে একাধিক সিনেমা। আর সব নির্মাতাই চাচ্ছেন সফলতার দৌড়ে নিজেদের ছবিকে এগিয়ে রাখতে। এর জন্য তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন অভিনব যত প্রচারণার। আসলে ছবির বাণিজ্যিক সফলতার জন্য এই অভিনব প্রচারণা (অনেকের মতে স্টান্টবাজি) বলিউডে বেশি হয়ে থাকে। ছবির প্রতি দর্শক দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নির্মাতা বা ছবির অভিনয় শিল্পীরা বেছে নেন এ পথ। মুক্তি প্রতীক্ষিত ছবি নিয়ে কোনো একটি গ্রুপকে দিয়ে ‘ছবিটিতে ধর্ম বা রাজনৈতিক উসকানিমূলক বক্তব্য, সংলাপ বা দৃশ্য আছে’ এমন দাবি তোলে ছবিটি মুক্তি পেলে সিনেমা হল জ্বালিয়ে দেওয়া হবে অথবা নির্মাতা ও শিল্পীদের হত্যা করা হবে- এমন হুমকি তৈরি করে রীতিমতো খবরের শিরোনাম হয়ে মাঠ গরম করা হয়। এতে ছবিটি নিয়ে দর্শকমনে তৈরি হয় ছবিটি সিনেমা হলে গিয়ে দেখার অতিরিক্ত আগ্রহ। সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন দর্শক, কাটা হয় অগ্রিম টিকিট। ফলশ্রুতিতে ছবিটি হিট। সাম্প্রতিককালে এমন ঘটনা ঘটেছে বলিউডে শাহরুখ খান ও দিপীকা পাড়ুকোন অভিনীত ‘পাঠান’ ছবিটির বেলায়। ছবি হিট করাতে বলিউডে এমন নজির অজস্র রয়েছে। এই ঈদে মুক্তি পেতে যাওয়া জ্বীন ছবিটি ছাড়াও আরেকটি ছবি মো. ইকবাল পরিচালিত অনন্ত-বর্ষা অভিনীত ‘কিল হিম’ ছবির প্রচার চালানো হচ্ছে এভাবে- ‘এই ছবিতে সবাই ভিলেন’। ছবির নায়ক অনন্ত জলিল বলছেন, ‘ছবির নায়িকা বর্ষা আমাকে ভিলেন বানিয়েছে, কীভাবে সে আমাকে ভিলেন বানালো তা দেখতে বড় পর্দায় চোখ রাখতে হবে।’ আবার নায়ক অনন্ত পুলিশের পোশাক পরা একটি ছবি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে দর্শকের কাছে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘ভিলেন অনন্ত’র গায়ে পুলিশের পোশাক কেন? তা দেখতে ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করুন আপনারা।’ আসলে এসবই হচ্ছে ছবির সাফল্য বয়ে আনতে অভিনব প্রচারণা বা কৌশল। ঢাকাই ছবিতে এর আগে বহুবার এমন অভিনব প্রচার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন নির্মাতারা- এমন কথা জানিয়ে সিনিয়র চলচ্চিত্র প্রযোজক ও প্রদর্শক মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, ‘১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া মমতাজ আলী পরিচালিত ও নায়ক উজ্জ্বল প্রযোজিত ও অভিনীত ‘নসিব’ ছবির ক্ষেত্রে এমন একটি অভিনব প্রচার কৌশল দেখা গিয়েছিল। আর তা হলো ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ল্যাবে পরিস্ফুটিত ছবি হলো নসিব।’ তৎকালে এমন বিগ বাজেটের ছবির কথা শুনে দর্শক ছবিটি দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ছবিটি সুপারহিট। মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, আসলে এটি ৩ কোটি টাকার ছবি ছিল না। ৩ কোটি মানে তখন অনেক টাকা। তখন একটি সমৃদ্ধ রঙিন ছবি নির্মাণ করতে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হতো না। এই সিনিয়র চলচ্চিত্রকার মজা করে বলেন, কথায় আছে না, ওই যে পুরনো অভিনব প্রচারণা ‘সিনেমার গরু গাছে চড়ে’,  একটি সিনেমায় গরু গাছে চড়ছে এমন ভুয়া প্রচার চালানোর ফলে ষাটের দশকের সহজ-সরল দর্শকরা সিনেমা হলে ছবিটিতে গরু কীভাবে গাছে চড়ে তা দেখতে ভিড় করে, কিন্তু  ছবিটির কোথাও গরুকে গাছে চড়তে দেখা যায়নি। ফলে দর্শকরা অসন্তুষ্ট হয় এবং তখন থেকেই এমন অভিনব প্রচারণার অবতারণা হলেই সবাই বলে ‘এটি অসম্ভব কিছু নয়, কথায় আছে না সিনেমার গরু গাছে চড়ে!’ এই নির্মাতা আরও জানান, ১৯৬৭ সালে ‘শহীদ তিতুমীর’ ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবির প্রতি দর্শক নজর কাড়তে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রচার চালায় এই বলে যে, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় আগুন লাগলে দর্শকরা চাইলেই তা নেভাতে পারবেন। এমন কথা শুনে অনেক দর্শক বালতি ভর্তি দুধ নিয়ে সিনেমা হলে যায় এবং ছবিতে বাঁশের কেল্লায় আগুন লাগলেই সিনেমা হলের পর্দায় দর্শকরা দুধ ঢেলে দিত। মিয়া আলাউদ্দীন আরও জানান, আগে একটি ছবি সফল করতে শুধু অভিনব প্রচারণাই চালানো হতো না,  আশ্রয় নেওয়া হতো নানা কৌশলের। যেমন- যে ছবিটির প্রথম টিকিট কাটবে সে পাবে আকর্ষণীয় পুরস্কার। অথবা ছবিটির বিক্রীত টিকিট লটারিতে তোলা হতো। এতে পুরস্কার হিসেবে বিজয়ী পেতেন টিভি, ফ্রিজ, রেডিও বা আরও অনেক মনকাড়া পুরস্কার। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকার রিটার্ন টিকিটেরও ব্যবস্থা থাকত। টিকিটের সঙ্গে আকর্ষণীয় উপহারও দেওয়া হতো। বর্ণিল প্রচার চালানো হতো ছবির পোস্টার-ব্যানার খচিত ঘোড়ার গাড়ি, ট্রাকের সারি, ব্যান্ড পার্টি নিয়ে সারা শহর-গ্রাম প্রদক্ষিণ করা, ছবির ব্যানার-পোস্টারে সজ্জিত অজস্র ট্রাকের সারি নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া, সিনেমা হলকে রঙিন বাতি আর ব্যানার দিয়ে সাজানো, মাইকে, রেডিও-টিভি ও পত্রিকায় আকর্ষণীয় প্রচার চালানো ইত্যাদি। ১৯৭৫ সালে প্রখ্যাত নির্মাতা আজিজুর রহমান তাঁর ‘সাম্পানওয়ালা’ ছবিটি মুক্তি দেওয়ার আগে কয়েক মাস ধরে দর্শকদের জন্য ছবিটি নিয়ে কুইজের আয়োজন করেন। বিজয়ীরা লাভ করেন এই ছবির গানের লং প্লে। মিয়া আলাউদ্দীনের কথায় ‘এমন অভিনব প্রচারণাকে ধাপ্পাবাজিও বলা হয়।’ অনেক সময় দেখা গেছে প্রচারের সঙ্গে বাস্তবতার মিল না পেলে ক্ষুব্ধ দর্শক সিনেমা হলে ভাঙচুর চালিয়েছে।

এদিকে, জ্বীন ছবির একা দেখে ১ লাখ টাকা পুরস্কার পাওয়ার জন্য এ পর্যন্ত প্রায় লাখের কাছাকাছি দর্শক আবেদন করেছেন। এখন দেখার বিষয় খুশির ঈদে ‘জ্বীন’ আসলেই কি অঘটন ঘটায়।

সর্বশেষ খবর