কাচকে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ভাবা হলেও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার অভাবে এটি ধীরে ধীরে নীরব দূষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। শহরাঞ্চলের উষ্ণতা বাড়াচ্ছে কাচের ভবন। অবহেলায় ফেলে রাখা বা ব্যবহৃত কাচ বাড়াচ্ছে বিপদ। গৃহস্থালি, নির্মাণ, শিল্প ও কৃষি খাতে ব্যবহৃত কাচের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় এটি মাটিতে মিশে উর্বরতা নষ্ট করছে, দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করছে, গ্রিন হাউস ইফেক্ট বাড়াচ্ছে এবং সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এমন পরিস্থিতিতে কাচের ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নে জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাড্ডার বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে (এসটিএস) জমা করেন ইয়াছিন। বর্জ্য হাতড়ে প্লাস্টিক, পুরনো ব্যাটারিসহ বিক্রয়যোগ্য জিনিসপত্র আলাদা করে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করেন। বর্জ্য হাতড়াতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ভাঙা কাচে কেটে যায় হাত। তবে থামে না কাজ। ক্ষত নিয়েই প্রতিদিন রোগ-জীবাণুভরা ময়লা হাতড়ে যান তিনি। তবে বিক্রির জায়গা না থাকায় বর্জ্য থেকে কখনো ভাঙা কাচ আলাদা করেন না ইয়াছিন। এসটিএস থেকে এগুলো চলে যায় ল্যান্ডফিলে। নগরের এই বর্জ্যকর্মী বলেন, অনেকেই কাচের বোতল, ভাঙা কাচ আবর্জনার সঙ্গে ফেলেন। কেউ কেউ কাগজে মুড়িয়ে ফেলেন। এতে মাঝেমধ্যেই হাত-পা কাটে। কাচের বোতল অনেক ভাঙারির দোকানে বিক্রি করা যায়। তবে ভাঙা কাচ কেনে না। তাই এগুলো সংগ্রহ করা হয় না।
গবেষণার তথ্য বলছে, ক্ষতিকর প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে মিশতে যেখানে ২০ থেকে ৪৫০ বছর লেগে যায়, সেখানে কাচবর্জ্য মাটিতে মিশতে লাগে প্রায় ১০ লাখ বছর। জৈব উপাদান না থাকায় কাচ কখনো পচে না। তাই ব্যবস্থাপনায় অবহেলা করলে পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি বয়ে আনবে কাচ। এটা শতাব্দীর পর শতাব্দী অবিকৃত থেকে মাটির উর্বরতা কমায়। ভাঙা কাচ মানুষ, পশুপাখি ও জলজ প্রাণীর জন্য বিপজ্জনক। এ ছাড়া কাচের তৈরি বহুতল ভবন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। শহরে হিট আইল্যান্ড বাড়াচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর এবং পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, তাপ ধরে রাখতে কাচের ভবন তৈরি করা হয় শীতপ্রধান দেশে। কাচ সূর্যের তাপ ভবনের ভিতরে প্রবেশ করতে দেয় কিন্তু বাইরে বের হতে দেয় না। এতে ভবনের ভিতরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে তাদের রুম হিটার চালাতে হয় না। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কাচের ভবন তৈরি হলো উল্টোপথে হাঁটার মতো। এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়াতে হয়। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। বেশি জীবাশ্ব জ্বালানি পোড়াতে হয়। সূর্যের আলো প্রতিফলিত করায় কাচের বিল্ডিংয়ের আশপাশের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আবার এসির কারণেও বাইরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে যায়। আগে বেসরকারি ভবনে কাচের ব্যবহার হতো, এখন সরকারি সব ভবন কাচ দিয়ে ঘেরা হচ্ছে। এজন্য এসব সরকারি অফিসে বিদ্যুৎ বিলও প্রচুর। এটা নিজের গলায় নিজে ছুরি চালানোর মতো। কাচের ভবন তৈরিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ খুবই জরুরি।
পরিবেশবিদরা বলছেন, কাচ এমন একটি পণ্য, যা শতভাগ পুনঃব্যবহারযোগ্য। এটা গলিয়ে আবার অন্য জিনিস তৈরি করা যায়। তবে সংগ্রহের অভাবে অনেক ভাঙা ও অব্যবহৃত কাচ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। কাচে পরিবেশ দূষণকারী উপাদান না থাকলেও এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও অব্যবস্থাপনা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। নির্মাণ বা কৃষিকাজে ব্যবহৃত কাচের টুকরো, বোতল বা কাচের প্যাকেজিং মাটিতে মিশে গেলে গাছের মূল বৃদ্ধিতে বাধা দেয় এবং পানিধারণ ক্ষমতা হ্রাস করে। এ ছাড়া যেসব শহরে কাচের ভবন বেশি, সেখানে দিনের তুলনায় রাতেও তাপমাত্রা কমে না, যা গড় শহুরে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কাচের ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা জরুরি। শহর উন্নয়ন পরিকল্পনায় ‘গ্লাস-রিফ্লেক্টিং’ স্থাপত্যে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। রিসাইক্লিং সুবিধা বৃদ্ধি ও পয়েন্ট-ভিত্তিক কাচ সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কাচ ব্যবহারকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠানকে কার্বন ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে।
টেকসই বিল্ডিংয়ের ওপর জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) এক প্রতিবেদন বলছে, শক্তিসাশ্রয়ী নকশা ছাড়া কাচের ভবন উষ্ণ দেশগুলোতে শীতলীকরণের চাহিদা ৫০ ভাগ বাড়িয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার (আইইএ) এক প্রতিবেদন বলছে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ২৮ ভাগের জন্য দায়ী ভবন ও বিভিন্ন স্থাপনা, যেখানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে কাচে ঘেরা উঁচু ভবনগুলো। ভারতের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের তথ্য বলছে, গরম আবহাওয়ায় কাচের ভবন ৩০ থেকে ৫০ ভাগ বিদ্যুৎ খরচ বাড়ায়।
জানা গেছে, দেশে কাচশিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে ১৯৬১ সালে, উসমানিয়া গ্লাসশিট কারখানার মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর বেসরকারি মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ হয়। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে রঙিন কাচের চাহিদাও। এ চাহিদা মেটাতে এগিয়ে আসেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। ১৯৯৭ সালে বেসরকারি খাতে প্রথম শিট গ্লাস উৎপাদন শুরু হয়। একে একে অনেক প্রতিষ্ঠান কাচ উৎপাদনে এগিয়ে আসে। এতে কাচের আমদানি-নির্ভরতা কমে আসে। সাশ্রয় হয় বৈদেশিক মুদ্রা। সব মিলিয়ে দেশে বছরে চার লাখ টনের বেশি কাচ উৎপাদন হয়। দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি মেটানো হচ্ছে স্থানীয় কাচ দিয়ে। তবে ব্যবহৃত কাচ ব্যবস্থাপনার অভাবে নীরবে এটা পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।