রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের পাশে চলছে মাসব্যাপী বৃক্ষমেলা। মেলার প্রবেশপথের এক পাশে লেখা ‘পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি’। অপর পাশে লেখা ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়’। আর সেই বৃক্ষমেলাই সয়লাব নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিকে। গাছ কিনলে বিনামূল্যে মিলে যাচ্ছে একাধিক পলিথিন ব্যাগ। পরিবেশবান্ধব বাণী লেখা গেটের মাঝ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে দিয়ে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যাগে গাছ নিয়ে বের হচ্ছেন ক্রেতারা। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে এমনটাই দেখা গেছে।
সময় তখন দুপুর ১২টার কাছাকাছি। প্রখর রোদেও বৃক্ষপ্রেমীরা ছুটে আসছিলেন মেলায়। তবে সংখ্যায় অনেকটাই কম। অধিকাংশই নারী ক্রেতা। ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন, ছবি তুলছিলেন, দরদামে মিলে গেলে কিনে ফেলছিলেন পছন্দের গাছ। গাছগুলোর গোড়ার মাটি আটকাতে ব্যবহার করা হয়েছে পিপি (সিমেন্টের ব্যাগ) ব্যাগ। সেই ব্যাগটি আবার পলিথিন ব্যাগে ঢুকিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে ক্রেতার হাতে। গাছটি একটু বড় হলে দেওয়া হচ্ছে একাধিক পলিথিন। পাঁচটি গাছের সঙ্গে মিলছে কমপক্ষে পাঁচটি পলিথিন ব্যাগ। এ ছাড়া পুরো মেলা প্রাঙ্গণের যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, একবার ব্যবহার্য চায়ের কাপ, প্লেট, চিপসের প্যাকেটসহ নানান ধরনের প্লাস্টিক বর্র্জ্য। দোকানগুলোতেও বিক্রির বিভিন্ন উপকরণ ও সরঞ্জামগুলোও রাখা হয়েছে পলিথিনের মোড়কে।
অথচ, এ বছরের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য-‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়’। গত ২৫ জুন বৃক্ষমেলার পাশাপাশি একই স্থানে পরিবেশ মেলা উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরিবেশ মেলা উদ্বোধনের সময় সবাইকে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জনের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘প্লাস্টিক পরিবেশের বিষ। এটা কেবল মানুষ নয়, পৃথিবীর সব প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। দূষণ রোধে কেবল পলিথিন বর্জন নয়, পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা প্রয়োজন। গোড়াতে উৎপাদন বন্ধ করতে পারলে পলিথিন বর্জনের বিষয়টা আর থাকে না।’ সেই স্থানেই গড়ে উঠেছে কয়েক টন পলিথিন ও প্লাস্টিকের সাময়িক বাজার!
এদিকে মেলার গেট দিয়ে ঢোকার পর ১৫-২০ গজ পার হলেই হাতের ডান পাশে রাখা হয়েছে ময়লা ফেলার একটি স্বচ্ছ বিন। দুপুরের মধ্যেই সেই বিনের অর্ধেকটা ভরে গেছে একবার ব্যবহার্য পলিথিন আর প্লাস্টিকে। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়েও রয়েছে নিষিদ্ধ বস্তুটি। অন্যদিকে কিছুক্ষণ পর পর বন বিভাগের তথ্য কেন্দ্র থেকে মাইকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উদ্দেশে বলা হচ্ছিল-পলিথিন ও প্লাস্টিক যত্রতত্র না ফেলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্য। বিষয়টি নিয়ে একাধিক ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধ হলে তো মেলায় পলিথিনই থাকত না। মাইকেও নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্য বলত না। মাদক সেবন নিষিদ্ধ। কারও কাছে মাদক পাওয়া গেলে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। মামলা হয়। সরকারের তরফ থেকে নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট স্থানে বসে সেবন করতে বলা হয় না।
পলিথিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক নার্সারির মালিক বলেন, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার না করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যবহার করা যাবে না-এমন নিষেধাজ্ঞা পাননি। এ ছাড়া অনেক ক্রেতাই গাছ কিনে পলিথিনে দিতে বলেন। পলিথিন দিতে না পারলে অন্য দোকানে চলে যান। সব দোকানে পলিথিন নিষিদ্ধ হলে আমরাও আনতাম না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থনীতি বিশ্লেষক এম জাকির হোসেন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টা প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো। বৃক্ষমেলার আয়োজনে আছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পলিথিন বন্ধ করবেও তারা। এখন যারা একটা কমপ্লায়েন্সের আয়োজক, তারাই যদি আইন ভঙ্গ করে সেখানে ভালো কি আশা করা যায়? পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও প্লাস্টিকের ব্যানার, পানির বোতল ব্যবহার করা হয়। বৃক্ষমেলার চারিদিকে প্লাস্টিকের ব্যানারে ছেয়ে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজস্ব বোর্ডের মতো পরিবেশ অধিদপ্তরের সংস্কার প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানটার রেগুলেটরি বডি আলাদা থাকলে এ ধরনের ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিত। এ ছাড়া যারা এই অধিদপ্তরে চাকরি পান, তারা তাদের ছাত্রজীবনে, কর্মজীবনে, ছোটবেলার কতটুকু পরিবেশবান্ধব ছিল সেটা শনাক্ত করা জরুরি।
তিনি বলেন, যতক্ষণ না পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা না হবে, ততক্ষণ এটা বন্ধ হবে না। হ্যাঁ, কিছু অভিযান হবে। তবে এটা হবে লোকদেখানো কসমেটিক্স পরিবর্তন, গোড়া থেকে স্থায়ী পরিবর্তন হবে না। ধূমপানে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। তাই এটার ওপরে ৩০০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে।
আর পলিথিন শত শত বছরেও পচে না। স্থায়ীভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। খাদ্যচক্র, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এটার ওপর ৫০০ শতাংশ কর আরোপ কেন হয় না? কেন ২০-৩০ পয়সায় একটা পলিথিন পাওয়া যায়? যতক্ষণ পর্যন্ত উৎসে হাত দেওয়া না হবে, পলিথিন বা প্লাস্টিক কমবে না। যুবশক্তি, ড্রোন, এআই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে পলিথিন উৎপাদনের রিয়েল টাইম ডেটা সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে যারা পরিবেশবান্ধব বিকল্প পণ্য তৈরি করছে তাদের প্রণোদনা দিতে হবে।