প্রকৃতি তার আপন গতিতে চলে। যখনই চলার সেই পথে বাধা আসে, রুষ্ঠ প্রকৃতি নিজেই তার প্রতিশোধ নেয়। কখনো ভূমিকম্প, কখনো ঘূর্ণিঝড় বা প্লাবনে ধ্বংস করে দেয় জনপদ। তবু নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন দেশ প্রকৃতির ওপর খবরদারি চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি বাঁধ দিয়ে নদী শাসনের ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাবের তথ্য উঠে এসেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায়। নদীতে তৈরি হওয়া হাজার হাজার বাঁধ অসংখ্য নদীর মৃত্যুই ঘটায়নি, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে! ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে পৃথিবী। হার্ভার্ডের ভূপদার্থবিজ্ঞানী ড. নাতাশা ভ্যালেন্সিক ও তাঁর গবেষকদল জানিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে নির্মিত প্রায় ৭ হাজার বড় বাঁধে যে বিপুল পরিমাণ পানি ধরে রাখা হয়েছে, তা ভূত্বকের ঘূর্ণন অক্ষকে প্রায় এক মিটার পর্যন্ত সরিয়ে দিয়েছে। ফলে পৃথিবীর চৌম্বক মেরুতে পরিবর্তন ঘটেছে এবং বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক ধাক্কায় নেমে গেছে প্রায় ২১ মিলিমিটার!
বিশেষজ্ঞরা জানান, পৃথিবীর চৌম্বক মেরু সব সময় এক জায়গায় স্থির থাকে না। এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করে। আগে চৌম্বক উত্তর মেরুটি ছিল কানাডার দিকে, কিন্তু বর্তমানে এটি দ্রুত রাশিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে। গবেষক ভ্যালেন্সিক বলেন, বাঁধ নির্মাণের ফলে পানির ভর এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, যা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করছে। এর প্রভাব পড়ছে চৌম্বক মেরু ও সমুদ্রপৃষ্ঠে।
গবেষণাটি আরও জানায়, ১৮৩৫ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে দুটি ধাপে চৌম্বক উত্তর মেরু উল্লেখযোগ্যভাবে সরেছে- প্রথমে রাশিয়ার দিকে এবং পরে উত্তর আমেরিকার দিকে। এর পেছনে রয়েছে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক বাঁধ নির্মাণ।
যদিও গবেষকরা বলেছেন, সব দিক থেকেই বিষয়টি খারাপ নয়। এসব বাঁধ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার গতি কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় এটি ইতিবাচক দিক। তবে চৌম্বক মেরুর ঘন ঘন পরিবর্তন ভবিষ্যতে নানাবিধ সমস্যা তৈরি করতে পারে। এর ফলে নেভিগেশন সিস্টেম, গভীর সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল, বিমানের দিকনির্দেশনায় বিভ্রান্তি, এমনকি গুগল ম্যাপেও ভুল দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া প্রভাব পড়তে পারে বায়ুমণ্ডল, সমুদ্রস্রোত এবং আগ্নেয়গিরির কার্যক্রমেও।
বিজ্ঞান ও গবেষণার তথ্য বলছে, পৃথিবীর দুই মেরুর অবস্থান স্থির হলেও চৌম্বক মেরু কোনো স্থির বিন্দু নয়, এটি পরিবর্তনশীল। উত্তর মেরুর কিছুটা দক্ষিণে অবস্থিত উত্তর চৌম্বকীয় মেরু। সেখানে পৃথিবীর ভূ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র উল্লম্বভাবে অবস্থান করছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা কোরের গতিশীলতার কারণে এই উত্তর চৌম্বকীয় মেরু গত কয়েক শতাব্দী ধরেই ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করে চলেছে। এখন এ ঘটনা ঘটছে আরও ঘন ঘন।
এ ব্যাপারে গবেষক ভ্যালেন্সিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বাভাবিক নিয়মে নদীর পানি সাগরে গিয়ে পড়বে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। যখনই আমরা বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখি, তখন একদিকে যেমন সমুদ্রতল নেমে যায়, সেসঙ্গে বিশ্বজুড়ে ভরের বণ্টনও বদলে যায়।’ এই ভরের পুনর্বণ্টনই পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর অবস্থানের ওপর প্রভাব ফেলে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এই গবেষক বলেন, একটি ঘূর্ণায়মান গোলকের সঙ্গে যদি অতিরিক্ত ওজন যুক্ত করা হয়, তা হলে দেখা যাবে, ভারী অংশটি ক্রমেই গোলকের বিষুব অঞ্চলের দিকে সরে যাচ্ছে। ফলে গোলকের ঘূর্ণন অক্ষটিও বদলে যায়। সে রকমই, পৃথিবীপৃষ্ঠে ভরের পুনর্বণ্টন হলে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষটিও বদলে যাবে। শুধু বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখাই নয়, হিমবাহের গলন, কিংবা ভূগর্ভস্থ পানি তুলে নেওয়ার কারণেও পৃথিবী ভারসাম্যহীন হচ্ছে। এগুলোর প্রভাব ভূচৌম্বক ক্ষেত্রের ওপরে পড়ে।
ভ্যালেন্সিক এবং তাঁর দল দেখিয়েছেন, চৌম্বকীয় উত্তর মেরু দুটি পর্যায়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। ১৮৩৫ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় পর্যাপ্ত বাঁধ তৈরির ফলে এটি পূর্বে রাশিয়ার দিকে প্রায় ২০ সেন্টিমিটার (৮ ইঞ্চি) সরে যায়। ১৯৫৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে এশিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকায় প্রচুর বাঁধ তৈরি হওয়ায় এটি উত্তর আমেরিকার দিকে ফের ৫৭ সেন্টিমিটার সরে যায়।
যদি পৃথিবীর উত্তর চৌম্বকীয় মেরুর অবস্থান ঘন ঘন বদলাতে থাকে, তা হলে কী হবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে গভীর সমুদ্রে কিংবা মহাসাগরে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়বে জাহাজ। আকাশে বিমানচালকদের দিশা দেখাতেও ভুল হয়ে যাবে। স্মার্টফোনে দেখানো গুগলের ম্যাপেও ভুলভ্রান্তি ধরা পড়বে। বায়ুমণ্ডলীয় স্তরের সংকোচন, সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত-সবকিছুতে প্রভাব পড়বে।