প্রকৃতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা রহস্যের এক অনন্য উদাহরণ হলো গ্লাস ব্যাঙ। এর শরীর এতটাই স্বচ্ছ যে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, যেন কাচ দিয়ে তৈরি। এর ইংরেজি নাম Glass frog হলেও Centrolenidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ব্যাঙগুলোক বোঝানো হয়। এদের বেশির ভাগই পাওয়া যায় মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্যাঁতসেঁতে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্যে।
গ্লাস ব্যাঙের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-এর স্বচ্ছ পেটের চামড়া। ওপরের দিক থেকে দেখলে এটি সাধারণত উজ্জ্বল সবুজ রঙের দেখা যায়, যা তাকে পাতার সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে। কিন্তু নিচ থেকে তাকালে দেখা যায় একেবারে স্বচ্ছ চামড়ার ভিতর দিয়ে এর হৃদস্পন্দন, লিভার, পাকস্থলি, এমনকি রক্ত চলাচলও! প্রকৃতির অন্য কোনো মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে এতটা স্বচ্ছ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খোলা চোখে দেখার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
এই স্বচ্ছ দেহ আসলে গ্লাস ব্যাঙের ক্যামোফ্লাজ কৌশল। রাতে তারা পাতার গায়ে বসে থাকে, আর নিচ থেকে যখন শিকারি তাকায়, তাদের কাছে দেহ প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়। পাতার সবুজের সঙ্গে মিলিয়ে শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে যায়, আর স্বচ্ছ পেট আলো প্রতিফলিত করে না। ফলে শিকারি পাখি বা সাপের চোখ এদের এড়িয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ কৌশলই এদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় রহস্য। গ্লাস ব্যাঙ আকারে ছোট, দৈর্ঘ্যে সাধারণত ২ থেকে ৭.৫ সেন্টিমিটার। রাতে সক্রিয় হয়ে থাকে এবং দিনের বেলা পাতার নিচে লুকিয়ে থাকে। বংশবিস্তারের সময় পুরুষ ব্যাঙ পাতার ওপরে ডিম পাড়ার উপযুক্ত জায়গা বেছে নেয়। স্ত্রী ব্যাঙ পাতার গায়ে ডিম পাড়ে, যা শিকারির হাত থেকে রক্ষা পায়। পুরুষ ব্যাঙ পাহারাদারির দায়িত্ব নেয়, আর ডিম ফোটার পর ছোট ব্যাঙাচিগুলো নিচের পানিতে পড়ে গিয়ে জীবনচক্র শুরু করে। এই ব্যাঙ শুধু বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য নয়, প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যের এক দারুণ নিদর্শনও। এর স্বচ্ছ দেহ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য কতটা বিস্ময়কর হতে পারে। গ্লাস ব্যাঙ যেন কাচের ভিতরে বন্দি এক জীবন্ত শিল্পকর্ম, যা একই সঙ্গে প্রকৃতির বিজ্ঞানের খোলা বই।
লেখক : পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক