অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূল ঘেঁষে কোরাল সাগরের নিচে অবস্থিত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ কেবল একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, এটি হলো পৃথিবীর সর্ববৃহৎ একক জীবন্ত কাঠামো। এর বিশালতা এমন যে, এটি মহাকাশ থেকেও স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই স্থাপত্যের মূল উপাদান হলো বিলিয়ন বিলিয়ন ক্ষুদ্র পলিপ নামক সামুদ্রিক প্রাণী। এই ছোট, সিলিন্ডার আকৃতির পলিপগুলো তাদের সুরক্ষার জন্য শরীর থেকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নামক শক্ত উপাদান নিঃসরণ করে। লাখ লাখ বছর ধরে মৃত পলিপের এই কঙ্কালগুলো জমতে জমতে তৈরি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ এই বিশাল পাথুরে প্রাচীর।
প্রবালের দ্রুত বৃদ্ধি এবং তাদের বিচিত্র রঙের রহস্য লুকিয়ে আছে টিস্যুর অভ্যন্তরে থাকা জুওজ্যান্থেলি নামক শৈবালের সঙ্গে তাদের মিথোজীবী সম্পর্কে। শৈবাল সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রবালকে খাদ্য ও শক্তি সরবরাহ করে, আর প্রবাল শৈবালকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়।
এই রিফ হলো সমুদ্রের তলদেশের বহু প্রজাতির প্রাণের এক বিস্তৃত বাসস্থান, যা জীববৈচিত্র্যের ‘হটস্পট’ হিসেবে পরিচিত। এটি প্রায় ৪০০ প্রজাতিরও বেশি প্রবাল, দেড় হাজারের বেশি প্রজাতির মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণের আশ্রয় ও প্রজনন ক্ষেত্র। এর গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ভূমিকার জন্য ১৯৮১ সালে এটিকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। এই প্রাচীর উপকূলীয় অঞ্চলকে সামুদ্রিক ঝড় থেকে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হিসেবেও রক্ষা করে।
তবে মানবসৃষ্ট কার্যকলাপের কারণে প্রকৃতির এই বিস্ময় আজ মারাত্মক ঝুঁকিতে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়লে প্রবালগুলো চাপে পড়ে তাদের শৈবালকে শরীর থেকে বের করে দেয়, যার ফলে কোরাল ব্লিচিং বা প্রবাল ধবলীকরণ ঘটে। ব্লিচিংয়ের শিকার হওয়া প্রবাল দীর্ঘকাল বাঁচতে পারে না এবং মারা যায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইডের কারণে সমুদ্রের অম্লীকরণ এবং মানুষের সৃষ্ট দূষণও এর জন্য বড় বিপদ।
এই জীবন্ত স্থাপত্যকে রক্ষা করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করাই প্রধান কর্তব্য। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সমুদ্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতন হওয়া আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। এই প্রাকৃতিক সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখার ওপরই নির্ভর করছে সামুদ্রিক জীবন ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।
লেখক : পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়