বর্ষা পার হয়ে যাই যাই করছে শরৎ ঋতুও। আকাশে সাদা মেঘ, আর মাটিতে শুভ্র কাশফুলে অপরূপ সাজে সেজেছে প্রকৃতি। তবে এই সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে রাজধানীবাসীর জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে দূষিত বাতাস। প্রতি বছরের মতো এবারও অক্টোবর আসতেই ঢাকার বায়ুদূষণ আবার বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল ছুটির দিনেও বায়ুদূষণে বিশ্বের ১২৭টি বড় শহরের মধ্যে শীর্ষে উঠে আসে ঢাকার নাম। বাতাসে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা ছিল সহনশীল মাত্রার চেয়ে অন্তত ১৬ গুণ বেশি। অথচ, যে সময় বায়ুদূষণে ঢাকা ছিল শীর্ষে, তখন বৃষ্টির পানিতে ভিজছিল নগরের পথঘাট।
বৃহস্পতিবার দিনভর ঢাকায় ছিল গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। গতকাল শুক্রবার ছিল বন্ধের দিন। বন্ধ ছিল কলকারখানা, অফিসপাড়া। রাস্তায় যানবাহন ছিল কম। দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয় থেমে থেমে বৃষ্টি। তারপরও ঢাকার বাতাস হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর। বেলা পৌনে ১২টার দিকে আন্তর্জাতিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের লাইভ বায়ুমান সূচকে (একিউআই) ১৬২ স্কোর নিয়ে বিশ্বের ১২৭টি বড় শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। বেলা ১টায় লাইভ র্যাঙ্কিংয়ে ১৬৮ স্কোর নিয়ে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে শহরটির নাম। বেলা দেড়টায় ১৭০ স্কোর শীর্ষে জায়গা নেয় ঢাকা। এ সময় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাহরাইনের মানামা ও তৃতীয় ভারতের কলকাতা। সোয়া ২টার দিকে দূষণ কিছুটা কমে ঢাকার স্কোর ১৫২-তে নামে।
বায়ুদূষণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদন ঘেঁটে জানা যায়, বৃষ্টি হলে বায়ুদূষণ কমে। তবে বৃষ্টির পানির সঙ্গে আকাশ থেকে দূষিত পদার্থ নিচে নেমে আসায় বৃষ্টির শুরুতে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি দূষণের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টির পর বাতাস নির্মল হয়।
বর্ষার কারণে গত ৪-৫টি মাস ঢাকার বায়ুর মান অনেকটা ভালো ছিল। মাঝেমধ্যে দূষণ কিছুটা বাড়লেও গড় দূষণমাত্রা সহনশীল পর্যায়ে ছিল। অনেকের ধারণা, অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশবান্ধব নানান উদ্যোগে বাতাসের মানের উন্নতি হয়েছে। তবে অক্টোবর আসতেই ঢাকার বাতাস তার চিরাচরিত রূপে ফিরতে শুরু করেছে। আইকিউ এয়ারের তথ্যানুযায়ী, ৯ অক্টোবর সকাল ৭টা থেকে গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত ৩০ ঘণ্টার মধ্যে ২৮ ঘণ্টাই অস্বাস্থ্যকর ছিল ঢাকা বাতাস। দুই ঘণ্টা ছিল স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। গতকাল সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ঢাকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা (পিএম ২.৫) ছিল গড়ে ৮২.৯ মাইক্রোগ্রাম, ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ৭০.৪ মাইক্রোগ্রাম, ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৫৮ মাইক্রোগ্রাম ও ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ৮২ মাইক্রোগ্রাম। অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমা অনুযায়ী সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫ থাকতে হবে ৫ মাইক্রোগ্রামের নিচে। অর্থাৎ, গতকাল নিরাপদ সীমার চেয়ে ১৬ গুণের বেশি দূষিত হয়ে ওঠে ঢাকার বাতাস।
বায়ুমান সূচকে (একিউআই) স্কোর ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাস্থ্যকর, ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সহনীয়, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত অসুস্থ, গর্ভবতী, শিশু, বৃদ্ধ এমন স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ৩০১ থেকে ৫০০ পর্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণের কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ শ্বাসতন্ত্রের নানান সমস্যায় ভুগছেন। হারাচ্ছেন কর্মক্ষমতা। কমছে আয়ু। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। স্বাস্থ্য খাতে খরচ বাড়ছে। পরিবেশবাদী সংগঠন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধু ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬০ জনের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। প্রতি বছর বায়ুদূষণের অর্থনৈতিক ক্ষতি ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদষূণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার বায়ুমানের সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান জানান, রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী মানুষ গত ৯ বছরে (৩ হাজার ১১৪ দিন) মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছেন। এই সময়ে ৮৫৩ দিনের বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। আর খুব অস্বাস্থ্যকর ও দুর্যোগপূর্ণ বাতাস ছিল যথাক্রমে ৬৩৫ দিন ও ৯৩ দিন। সবচেয়ে বেশি দূষিত বাতাস ছিল ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। ওই মাসে সূচকে গড় বায়ুমান ছিল ৩০০। তিনি বলেন, বর্ষা গেলে ইটভাটাগুলো চালু হয়। নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ হয় না। নিষিদ্ধ হলেও খোলা গাড়িতে নির্মাণসামগ্রী পরিবহন চলছে। রাস্তায় পড়ে থাকা ধুলোবালি গাড়ির চাকার সঙ্গে উড়ে বাতাসে মিশছে। কালো ধোঁয়া ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ হচ্ছে না। নগরায়ণের কারণে জলাশয় ও গাছ কমে যাচ্ছে। এই সবগুলোই বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। দূষণ রোধে আইন থাকলেও বাস্তবায়ন নেই।