প্রকৃতিতে এমন কিছু প্রাণী আছে যা দেখতে অদ্ভুত হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে অন্যতম হলো নগ্ন তিল ইঁদুর (ন্যাকেড মোল র্যাট)। ছোট্ট এই ইঁদুরটি দেখতে ভদ্র, শান্ত এবং দেহে তেমন দাগ না থাকায় একে ‘নগ্ন’ বলে অভিহিত করা হয়। এদের দেহে লোম খুবই সামান্য, চোখ ছোট, আর কোদালের মতো বাঁকানো দাঁত দিয়ে তারা মাটির নিচে সহজেই খোঁড়াখুঁড়ি করতে পারে। এরা দেখতে যেমন অদ্ভুত তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হলো এর স্বাস্থ্য এবং জীবনকাল।
নগ্ন তিল ইঁদুর ক্যানসারের প্রতি প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধী। মানুষের দেহে যেমন কোষ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিভাজিত হয়ে ক্যানসার সৃষ্টি করে, এই ইঁদুরের দেহে সেই সমস্যা প্রায় ঘটে না। গবেষকরা দেখেছেন, এদের দেহে থাকা একটি বিশেষ প্রোটিন, যার নাম হাই মলিক্যুলার ওয়েট হায়ালুরোনান (এইচএমডব্লিউ-এইচএ), কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজন বা বৃদ্ধি রোধ করে। এর ফলে তাদের দেহের কোষ ক্যানসারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। নগ্ন তিল ইঁদুরের জীবনকালও খুব দীর্ঘ। সাধারণ ছোট ইঁদুরের জীবনকাল মাত্র কয়েক বছর, কিন্তু নগ্ন তিল ইঁদুর ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। তাদের দেহে বার্ধক্য ধীরগতিতে আসে এবং বয়স বাড়লেও কোষের ক্ষয় কম হয়। এ কারণে তারা প্রাকৃতিকভাবে বয়সজনিত রোগে কম আক্রান্ত হয়।
বিজ্ঞানীরা এই প্রাণী নিয়ে আরও আবিষ্কার করেছেন যে, নগ্ন তিল ইঁদুরের কম অক্সিজেনের মধ্যেও বেঁচে থাকার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। তারা মাটির নিচে অনেকটা অক্সিজেনহীন পরিবেশে বাস করে, যেখানে সাধারণ স্তন্যপায়ী প্রাণী খুব শিগগিরই মারা যায়। এ ধরনের অভিযোজন তাদের কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
নগ্ন তিল ইঁদুরের এই বৈশিষ্ট্য মানবদেহে ক্যানসার প্রতিরোধ ও বার্ধক্য বিলম্বের গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এদের শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া বোঝার মাধ্যমে ভবিষ্যতে মানুষের জন্য নতুন ধরনের ওষুধ বা থেরাপি উদ্ভাবন সম্ভব হতে পারে।
ছোট্ট, অদ্ভুত এই নগ্ন তিল ইঁদুর আমাদের শেখায়, প্রকৃতি কেবল সৌন্দর্য নয়, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক। প্রকৃতি-পরিবেশ, উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে সৃষ্টিকর্তা এমন এমন অদ্ভুত এবং কার্যকরী বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন, যা আমাদের স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষায় নতুন পথ দেখাতে পারে।
লেখক : পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়