মাত্রাতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু। ক্রমাগত বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। এর প্রভাব শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্যও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরমে কাজ করতে না পারায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে প্রায় ২৫ কোটি কর্মদিবস হারাতে হয়েছে। এতে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন থেকে ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘অ্যান আনসাস্টেইনেবল লাইফ : দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিট অন হেলথ অ্যান্ড দ্য ইকোনমি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
অন্যদিকে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় ঋণ করে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু জলবায়ু ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬ মার্কিন ডলার, যা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের ভাবনায় থাকা দেশটিকে। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানাভাবে ক্ষতির মুখে বাংলাদেশ। অন্যদিকে এই ধাক্কা সামলাতে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো থেকে প্রাপ্য জলবায়ু তহবিলের অর্থ অনুদানের পরিবর্তে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঋণ হিসেবে। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঋণের বোঝা। সিডিআরআই (ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স)-২০২৫ সূচকে জলবায়ু ঋণে ঝুঁকিপূর্ণ ৫৫টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। এতে দেখা গেছে, সব স্বল্পোন্নত দেশে জলবায়ু অর্থায়নের ৭০ ভাগের বেশি আসছে ঋণ হিসেবে, যা প্যারিস চুক্তির ‘দূষণকারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়’ নীতি এবং জলবায়ু ক্ষতিপূরণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের ২০২৫ সালের রায়ের সরাসরি লঙ্ঘন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ‘ফিলস-লাইক’ তাপমাত্রা বা অনুভূত তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ তাপমাত্রা যতটা বাড়ছে, তার চেয়ে চারগুণ অনুভূত হচ্ছে। গরমের প্রভাবের দিক বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকার তাপ সূচক জাতীয় গড়ের তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি বেড়েছে, যার পেছনে বায়ুদূষণকে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাতসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত বছর ৩০ এপ্রিল যশোরে ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা ৫২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৭২ সালের ১৮ মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল রাজশাহীতে ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার গত বছর ৩১ মার্চ থেকে ৬ মে পর্যন্ত টানা ৩৭ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে যায় দেশের ওপর দিয়ে। ১৯৪৮ সাল থেকে রেকর্ড রাখা শুরুর পর এত দীর্ঘ সময় টানা তাপপ্রবাহের রেকর্ড কখনো হয়নি। ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই হিটস্ট্রোকে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছিল। কৃষক মাঠে যেতে পারেননি। জমির ধান চিঁটা হয়ে যায়। অনেক শ্রমজীবী মানুষ অলস সময় কাটিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, তাপমাত্রা বাড়লেই শারীরিক ও মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রায় বিষণ্নতা ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং উদ্বেগ ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে যায়। শীতে দীর্ঘমেয়াদি কাশিতে আক্রান্তের হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা গ্রীষ্মে বেড়ে হয় ৬ শতাংশ। গ্রীষ্মে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, যা শীতে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর এসব অসুস্থতায় বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় কাজ করতে পারেন না কর্মক্ষম মানুষ। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণে গ্রীষ্মকালে মানুষ গড়ে ১ দশমিক ৪ দিন এবং শীতে ১ দশমিক ২ দিন কাজ হারান। বয়সভেদে ৩৬ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মানুষের ক্ষেত্রে কাজ হারানোর হার সবচেয়ে বেশি। তারা গ্রীষ্মে গড়ে ১ দশমিক ৭ দিন এবং শীতে ১ দশমিক ৪ দিন শারীরিক অসুস্থতায় কাজ হারিয়েছেন। মানসিক সমস্যার কারণে গ্রীষ্মে আড়াই দিন এবং শীতে দুই দিন কাজ হারানোর ঘটনা ঘটেছে। তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৪.৯ শতাংশ পর্যন্ত লোকসান হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে তথ্য বলছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য মূলত দায়ী বিশ্বের বড় দেশগুলো। তারা শিল্পের নামে বৈশ্বিকভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন (কার্বন ডাই-অক্সাইড ও আনুষঙ্গিক গ্যাস) বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে বিশ্বের ৩০.১ শতাংশ (সর্বাধিক) গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১১.৩ শতাংশ ও ভারত ৭.৮ শতাংশ নিঃসরণের জন্য দায়ী। সে তুলনায় বাংলাদেশের নির্গমন ০.৫ শতাংশের নিচে। তারপরও ভৌগোলিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। তাপমাত্রার দ্রুত বৃদ্ধি, কাজের ঘাটতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও উৎপাদনশীলতার পতন ঘটাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের তথ্য বলছে, ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ১৩ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার।