বাংলাদেশের নদীনালা, হাওড়-বাঁওড় ও উপকূলীয় এলাকায় একসময় প্রচুর শামুক ও ঝিনুক দেখা যেত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটি। গবেষণা বলছে, গত দুই দশকে দেশের অধিকাংশ জলাশয়ে শামুক-ঝিনুকের সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর পেছনে রয়েছে দূষণ, রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত আহরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল পরিবেশগত কারণ। এই বিলুপ্তি শুধু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে না, মানুষের খাদ্যচক্রেও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি তৈরি করছে। মানবদেহে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি ও হাড় ক্ষয় রোগ বৃদ্ধির পেছনে এর পরোক্ষ প্রভাব আছে বলে ধারণা অনেকের।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশে হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপরোসিস রোগীর সংখ্যা গত এক দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির তথ্যমতে, দেশের বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ হাড় ক্ষয় রোগে ভুগছেন। এই রোগে হাড়ের ঘনত্ব ও গুণগত মান কমে যায়। হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, ফলে সামান্য আঘাতেই ভেঙে যেতে পারে। মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি এবং এর কারণে মৃত্যুঝুঁকি প্রায় আট গুণ বেড়ে যায়। স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, হাড় ক্ষয় রোগ বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছে দীর্ঘমেয়াদে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি ঘাটতি। খাবার থেকে প্রতিদিন যে ক্যালসিয়াম পাওয়া দরকার, অধিকাংশ মানুষ তা পাচ্ছে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, শামুক ও ঝিনুক প্রকৃতিতে ক্যালসিয়াম চক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের খোলস তৈরি হয় ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে, যা ভেঙে মাটি ও পানিতে ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে। এদের সংখ্যা কমায় সেই প্রাকৃতিক ক্যালসিয়াম উৎস হ্রাস পাচ্ছে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের খাদ্যচক্রে ক্যালসিয়াম ঘাটতি দেখা দিতে পারে। পানি, মাছ ও শাকসবজিতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে এটি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, শামুক-ঝিনুক শুধু জলজপ্রাণী নয়, এগুলো একটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের ভিত্তি। এর উপকারিতা বহুমাত্রিক। ঝিনুক ও কিছু শামুক পানি পরিশোধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি ঝিনুক দিনে ৫০-১০০ লিটার পর্যন্ত পানি পরিশোধন করতে পারে। এগুলো কমে গেলে নদনদী, হাওড়-বাঁওড়ের পানি পরিশোধনের প্রাকৃতিক ক্ষমতা কমে যায়। শামুক-ঝিনুকের মল, খোলস ও মৃতদেহ থেকে ক্যালসিয়াম, নাইট্রোজেন ও ফসফরাস মাটিতে মেশে, যা গাছের জন্য পুষ্টি সরবরাহ করে। ঝিনুকের খোলস বা কলোনি ছোট মাছ, কেঁচো, কাঁকড়া ও অন্যান্য জীবের জন্য আশ্রয় তৈরি করে। ঝিনুকের বিছানা ভাঙন প্রতিরোধে প্রাকৃতিক বাঁধ হিসেবে কাজ করে। শামুক ও ঝিনুক বহু প্রাণীর (মাছ, পাখি, কাঁকড়া, এমনকি মানুষও) খাদ্য উৎস। শামুক-ঝিনুক কমে গেলে প্রকৃতির ক্যালসিয়াম চক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানিতে ও মাটিতে ক্যালসিয়ামের সরবরাহ ধীরে ধীরে কমে যায়। এতে ক্যালসিয়াম-নির্ভর উদ্ভিদ ও প্রাণীদের হাড়, খোলস বা দাঁত দুর্বল হয়ে যায়। ইউরোপে কিছু হ্রদে অ্যাসিড বৃষ্টির কারণে শামুক ও ঝিনুক মারা যাওয়ার পর দেখা যায়, সেখানকার পাখিদের ডিমের খোসা পাতলা হয়ে গেছে। সব মিলে এই জলজপ্রাণীটির সংখ্যা কমতে থাকায় হুমকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।
পরিবেশবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে শামুক-ঝিনুক কমে যাওয়ার পেছনে মূলত শিল্পবর্জ্য, কীটনাশক ও ভারী ধাতুর দূষণ এবং অতিরিক্ত আহরণ দায়ী। দূষণে নদীতে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক নিচে নেমে গেছে। শামুক-ঝিনুকের মতো জীবেরা এতে সবচেয়ে আগে মারা যায়। এ ছাড়া জলাশয় ভরাট, ড্রেজিং, বাঁধ নির্মাণ ও জাল ফেলার সময় তাদের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। ফলে প্রজননের সুযোগও কমে গেছে। বরিশাল, খুলনা ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে জালের সাহায্যে অল্প বয়সের শামুকও তুলে ফেলা হচ্ছে। ফলে পরবর্তী প্রজন্ম টিকে থাকতে পারছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদা চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শামুক-ঝিনুক জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রকৃতিতে ছোট বলে মনে হলেও এর ভূমিকা বিশাল। এগুলো বিলুপ্ত হলে মাটি, পানি, কৃষি, মানবস্বাস্থ্য-সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দূষণ, রাসায়নিক কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, জলাশয় ভরাট ও অতিরিক্ত আহরণসহ নানান কারণে এগুলো কমে যেতে পারে। এর কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা প্রয়োজন। সরকার ‘শামুক-ঝিনুক সংরক্ষণ প্রকল্প’ হাতে নিতে পারে। নদী ও হাওড়ের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ, প্রজনন মৌসুমে শামুক আহরণ বন্ধ রাখা, প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ, এবং সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। এখনই ব্যবস্থা না নিলে কয়েক বছরের মধ্যেই কিছু প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।