গাছ আমাদের নীরবে অক্সিজেন ও ছায়া দেয়, ফুল-ফল ও কাঠ সরবরাহ করে। গাছকে আমরা অন্যান্য প্রাণীর মতো হাঁকডাক করতে শুনি না। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতেও দেখি না। তাই বলে গাছ কি একেবারে নিষ্ক্রিয়? না, তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও করে! অবিশ্বাস্য মনে হলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, গাছেরাও একে অপরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে। তারা শব্দ ব্যবহার করে না, বরং রাসায়নিক সংকেত, বৈদ্যুতিক সংকেত এবং মাটির নিচের জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ‘কথা বলে’।
গাছেরা যখন পোকামাকড় বা তৃণভোজী প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয় তখন তারা আশপাশের গাছগুলোকে সতর্ক করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ-অ্যাকাসিয়া গাছের পাতা যখন হরিণ খেয়ে ফেলে তখন আক্রান্ত গাছটি ইথিলিনসহ বিভিন্ন উদ্বায়ী রাসায়নিক নিঃসরণ করে। এ সংকেত পেয়ে পাশের গাছগুলো তাদের পাতায় ট্যানিন বা বিষাক্ত রাসায়নিক বৃদ্ধি করে, যাতে পাতা তেতো বা বিষাক্ত হয়ে যায় এবং হরিণ বা পোকা সেগুলো এড়িয়ে চলে।
এমনকি টম্যাটো গাছের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে একবার কোনো গাছে পোকা আক্রমণ করলে আশপাশের গাছগুলো দ্রুত প্রতিরক্ষামূলক এনজাইম তৈরি শুরু করে। এ পদ্ধতিকে ‘প্রাইমিং’ বলা হয়, যেখানে গাছগুলো আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে বিপদ মোকাবিলা করে।
গাছের যোগাযোগ শুধু বাতাসে রাসায়নিক সংকেত পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। মাটির নিচে গাছের শিকড়ের সঙ্গে মাইকোরাইজাল ছত্রাকের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক থাকে, যাকে বিজ্ঞানীরা ‘উড ওয়াইড ওয়েব’ নাম দিয়েছেন। এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গাছেরা একে অপরের সঙ্গে পুষ্টি, জল এবং বিপদের সংকেত আদান-প্রদান করে।
মজার বিষয় হলো- এ ছত্রাক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বড় ও প্রাপ্তবয়স্ক গাছগুলো ছোট গাছদের সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি গাছ যখন মারা যায় তখন সে তার শিকড়ের মাধ্যমে পুষ্টি অন্য গাছের দিকে পাঠাতে পারে। এমনকি কিছু গাছ আক্রান্ত হলে প্রতিবেশী গাছগুলো তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে নেয় এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে।
গাছের এ যোগাযোগ পদ্ধতি প্রমাণ করে যে, তারা কেবল স্বার্থপরভাবে বেঁচে থাকে না, তাদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমবেদনাও রয়েছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, একই প্রজাতির গাছ পরস্পরকে সাহায্য করে, এমনকি অন্য প্রজাতির গাছের সঙ্গেও সহাবস্থান করে। গাছেরা নিঃশব্দে কথা বলে, বিপদে সতর্ক করে এবং একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে। গাছের এ নীরব যোগাযোগ আমাদের একে অপরের প্রতি সহযোগিতা ও সংবেদনশীলতা শেখায়। আমরা যদি প্রকৃতিকে বাঁচাতে চাই তাহলে গাছের এ ভাষাকে বুঝতে হবে এবং বনাঞ্চল ধ্বংস, রাসায়নিক দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। গাছেরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে, তাই তাদের রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। গাছের ভাষা বুঝতে পারলে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে সত্যিকারের সম্প্রীতি গড়ে তুলতে পারব।
লেখক : পরিবেশ-জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।