বেলকনির টবে হোক বা কৃষি জমিতে, গাছের বেঁচে থাকতে দরকার মাটি। মাটি থেকে পুষ্টি নিয়েই বেড়ে ওঠে বৃক্ষরাজি। আর প্রতিনিয়ত জৈব বস্তু পরিচয়ে নতুন মাটি তৈরি করে মাটিতে বসবাসকারী অণুজীব। অব্যাহত রাখে পুষ্টির জোগান। প্লাস্টিক এ অণুজীবের বৃদ্ধি আটকে দেয়। ফলে তৈরি হয় না নতুন মাটি। ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণে উর্বরতা হারিয়ে ক্রমাগত বন্ধ্যা হচ্ছে বাংলাদেশের মাটি। এতে ঝুঁকির মুখে সব ধরনের ফসল উৎপাদন। জরুরি ভিত্তিতে প্লাস্টিকদূষণ বন্ধ করতে না পারলে তথাকথিত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে পুরোপুরি আমদানির্ভর দেশে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতিনিয়ত নতুন মাটি তৈরি হয়। মাটির অণুজীব জৈব পদার্থ পরিচয়ে মাটিকে উর্বর করে। পলিথিন বা প্লাস্টিক থাকলে অণুজীব বাড়ে না। নতুন মাটি তৈরি হয় না। আবার প্লাস্টিক বা পলিথিনের কারণে গাছ শিকড় বিস্তার করতে পারে না। এতে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। আপাতদৃষ্টে প্রভাবটা হয়তো চোখে লাগছে না, কিন্তু ভবিষ্যৎ খুবই ভয়াবহ। কৃষিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ঢাকায় বাসাবাড়ির ময়লা সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। কিন্তু, সারা দিন পথেঘাটে যত চিপস, চানাচুর, বিস্কুটের প্যাকেট পরিবেশেই ছড়িয়ে পড়ে। আর গ্রামে তো ময়লা সংগ্রহই করা হয় না। এ জন্য গ্রামে হাটবাজারের আশপাশের জমিতে তেমন ফসল হয় না। লোকালয় থেকে দূরের কৃষিজমি পরিষ্কার মনে হলেও সেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে গেছে। হয়তো সরাসরি পলিথিন পড়ছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে বাতাসে উড়ে বা পানির সঙ্গে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। সেচের পানির সঙ্গে এসব জমিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক জমছে। নদনদীর পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক ভরে গেছে। মাছের দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। খাবারের মাধ্যমে এসব প্লাস্টিক আমাদের শরীরে ঢুকে ক্যানসারসহ নানা রোগ জন্ম দিচ্ছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ২৩ বছর আগে পলিথিন নিষিদ্ধ করার আগে একটা পলিথিন ব্যাগের দাম ছিল ১-২ টাকা। মূল্যস্ফীতি ধরলে এখন সেগুলোর দাম হওয়া উচিত অন্তত ১০-১৫ টাকা। অথচ বর্তমানে ২০-৩০ পয়সায় পলিথিন ব্যাগ মিলছে। দোকানিরা পাঁচটি পণ্যের সঙ্গে পাঁচটি পলিথিন বিনামূল্যে দিচ্ছে। ১০০ গ্রাম আদা কিনলেও ঘরে আসছে একটি পলিথিন। প্লাস্টিক বোতলের একটি অংশ রিসাইকেল হলেও পলিথিন সবটাই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলো গুঁড়ো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক আকারে পরিবেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। আবার আধুনিকতার নামে নতুন আপদ হিসেবে যুক্ত হয়েছে ওয়ানটাইম প্লেট, গ্লাস, কাপ, বাটি। আগে অনেক মুদিপণ্য খোলা বিক্রি হলেও এখন সবই প্লাস্টিকে মোড়া। বর্তমানে একটা মুদি দোকানে আলু, পিঁয়াজ, রসুন, আদা ছাড়া বাকি সব পণ্যই প্লাস্টিকের মোড়কে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ৯৫ ভাগের বেশি পণ্য প্লাস্টিকের মোড়কে বিক্রি হচ্ছে। দেশের ১৭ কোটি মানুষ প্রতিদিন এসব পণ্য কিনছে আর পরিবেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষতিকর প্লাস্টিক। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শুধু একবার ব্যবহার্য পলিথিনের বিরুদ্ধে সরব হয়েও ১১ মাসে তা বন্ধ করতে পারেনি। এমনটা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, চরম খাদ্যঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহার্য পলিথিন ও প্লাস্টিক বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। এসব অপচনশীল দ্রব্য কৃষিজমি, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদীনালা, খালবিল ও সমুদ্রে পতিত হয়ে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও কৃষির মারাত্মক ক্ষতি করছে। প্লাস্টিক বিষে নীল পুরো বিশ্ব। বর্তমানে বছরে বিশ্বে ৩৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক আবর্জনা উৎপাদিত হয়। এটা নিয়ে বৈশ্বিকভাবে নীতিমালায় পরিবর্তন আনা না হলে ২০৬০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন তিন গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, মুদি দোকানের পণ্য বিক্রিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর; চা, কফি, জুস তথা কোমল পানীয়ের প্লাস্টিক কাপের ক্ষেত্রে সময় লাগে ৫০ বছর; প্লাস্টিকের বোতল প্রকৃতিতে অবিকৃত থাকে প্রায় ৪৫০ বছর। বছর দুই আগে একটি বেসরকারি সংস্থা ঢাকার চারপাশের নদীতীরের মাটি খুঁড়ে প্রতি টন মাটিতে আধা কেজি থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত প্লাস্টিক পায়। সেখানে ১৫ বছরের পুরোনো প্লাস্টিকেরও দেখা মেলে।
গত সপ্তাহে চকবাজারে পলিথিনের একটি পাইকারি দোকানে গিয়ে জানা যায়, তারা কাপড় প্যাকেট করার জন্য পলিব্যাগ বিক্রি করেন। তাদের দোকান থেকে প্রতিদিন তিন থেকে চার মণ প্লাস্টিকের ব্যাগ খুচরা দোকানিরা কিনে নেন। অনেকে ঢাকার বাইরে থেকে ফোনে অর্ডার করেন। তখন তারা পার্সেল করে পাঠিয়ে দেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক আমিনুর রসুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিষিদ্ধ পণ্য কীভাবে প্রকাশ্যে বিক্রি হয়, কীভাবে কারখানা বাড়ে সেটাই মাথায় ধরে না। নিশ্চয়ই এখানে বড় রকমের দুর্নীতি আছে। সবাই এটার ভাগ পায়।
পলিথিনের সহজলভ্যতায় কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাওয়ার সংস্কৃতি উঠে গেছে। পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করলে আপনা-আপনি বিকল্প চলে আসত।