চতুর্মুখী দূষণের কবলে দেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য। পানিদূষণ, মাটিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্যরে দূষণ-সব ক্ষেত্রেই বিশ্বে শীর্ষ সারিতে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। পরিবেশ দূষণের কারণে এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে নানা প্রজাতির পশু, পাখি, মাছ ও কিটপতঙ্গ। বর্তমান অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে নানামুখী দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও ১১ মাসেও আসেনি দৃশ্যমান পরিবর্তন। কমেনি পলিথিনের ব্যবহার, খাল ও নদীতে শিল্পদূষণ বন্ধ হয়নি, সড়কে বন্ধ হয়নি হর্নের তাণ্ডব। দূষণ ঠেকাতে গলদ্ঘর্ম হতে হচ্ছে সরকারকে। শুধু বর্ষার কারণে কমেছে বায়ুদূষণ।
পলিথিন ও প্লাস্টিকদূষণ : ২০০২ সালেই দেশে নিষিদ্ধ করা হয় পলিথিন ব্যাগ। তখন কয়েক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিষিদ্ধ বস্তুটি। পরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ক্রমেই বেড়েছে এর উৎপাদন ও ব্যবহার। বর্তমান অরাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যেহেতু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সুবিধা দেওয়ার বিষয় নেই, তাই সচেতনমহল আশা করেছিল এবার হয়তো থামবে পলিথিন আগ্রাসন। তবে ১১ মাস পরও বাজারে প্রতিটি সবজির সঙ্গে বিনামূল্যে মিলছে একটি পলিথিন ব্যাগ। আসেনি পলিথিনের বিকল্প। অভিযানে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে হামলার শিকার হয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আবার আটক করা মালামাল রেখেও ফিরে আসতে হয়েছে। রাজধানীতে চলমান বৃক্ষমেলা থেকে বিক্রিত গাছের সঙ্গে প্রতিদিন বের হচ্ছে ৮-১০ হাজার পলিথিন ব্যাগ। অথচ মেলার প্রবেশপথেই লেখা রয়েছে-‘প্লাস্টিকদূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়’। এমন পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার এক বৈঠকে দেশে পলিথিনবিরোধী যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিদ্ধান্ত অনেক আছে, বাস্তবায়ন কতটুকু হয় সেটাই দেখার অপেক্ষা।
সব দূষণ রোধে আইন আছে। অনেক আইন হতে না হতে আবার নিজেদের সুবিধামতো বদলে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সুফল তো পাচ্ছি না। এভাবেই চলছে, চলবে। কষ্ট হচ্ছে, তবুও প্রতিটি মানুষ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করছি।
অধ্যাপক ড. এ আতিক রহমান
পানিদূষণ : বর্তমান সরকার রাজধানীর বিভিন্ন খাল পরিষ্কারের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো খালে পানিপ্রবাহ সচল হয়েছে। তবে সেই পানিতে নেই মাছ। আছে শুধু মশার বাচ্চা। সরেজমিন কয়েকটি খালে দেখা গেছে, মানববর্জ্য ও শিল্পদূষণে কুচকুচে কালো পানি। সেই পানি ভেদ করে অনবরত উঠছে মিথেন গ্যাস। খালের পাশে গেলেই দুর্গন্ধে নাক চাপতে হচ্ছে। বর্ষায়ও পানির মানের খুব একটা উন্নতি হয়নি। তুরাগ, বুড়িগঙ্গা ও বালু নদের পানিরও একই দশা। খালের দূষিত পানি পড়ছে এসব নদীতে। নদীগুলোতে সরাসরিও পড়ছে অনেক শিল্পকারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত পানি।
শব্দদূষণ : সরকার শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিধিমালা সংশোধন, রাজধানীর অনেক স্থানকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করলেও বাস্তবে তা শুধু ঘোষণা ও কাগজে-কলমেই টিকে আছে। নীরব এলাকা ঘোষিত বিভিন্ন হাসপাতাল, স্কুল ও এয়ারপোর্ট এলাকায় থামেনি হর্নের তাণ্ডব। লাখ লাখ গাড়ি ও মোটরসাইকেলের অহেতুক হর্নে যখন নগরবাসী অতিষ্ঠ, তখন দিনভর অভিযান চালিয়ে ৫-৬টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সড়ক বিভাগ। আবার রাজধানীর মোটরসাইকেল পার্টসের দোকানগুলোতে অনায়াসে মিলছে হাইড্রোলিক হর্ন ও হুটার হর্ন। তবে ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন সদস্য বলেন, গাড়ির সঙ্গে যে বিল্টইন হর্ন থাকে, সেটার শব্দমাত্রাও অনেক বেশি। ১০-১২টা গাড়ি একসঙ্গে হর্ন বাজালে কান ধরে যায়।
বায়ুদূষণ : শীতকালে প্রায় প্রতিদিনই বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান থাকত বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে। তবে বর্ষায় কমেছে এ নগরের বায়ুদূষণ। গতকাল দুপুরে বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল বিশ্বের ১২৬টি শহরের মধ্যে ১৩তম। বায়ুর মান ছিল সহনশীল। তবে এখনো রাস্তায় কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী অনেক যানবাহন দেখা যাচ্ছে, যার অধিকাংশ ট্রাক, ট্যাঙ্কলরি ও বিআরসিটির বাস।
দূষণের বিষয়ে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. এ আতিক রহমান অনেকটা আক্ষেপ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের সব দূষণ রোধে আইন আছে। আইন বাস্তবায়নের লোকও আছে। আবার অনেক আইন হতে না হতে আবার নিজেদের সুবিধামতো বদলে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সুফল তো পাচ্ছি না। পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ এখনো প্রতিটি বাজার থেকে সকালে অন্তত ১০ হাজার পলিথিন বের হয়। বিকল্প না আসা পর্যন্ত এটা বন্ধ হবে না। অনেক কিছু বলা সহজ, করা কঠিন। আমরা নিজেরাই তো সচেতন হতে পারছি না। বাজারে গিয়ে প্রতিটি পণ্য আলাদা পলিথিনে দিতে বলি। পলিথিনে খাল, বিল, নদীর তলদেশে স্তর পড়ে গেছে। পানি ভূগর্ভে যেতে পারছে না। মাটি নষ্ট হচ্ছে। এভাবেই চলছে, চলবে। কিছুই তো থেমে নেই। প্রতিটা মানুষ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করছি। যেমন আমাদের আয় বাড়ছে, কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে কেনার সক্ষমতা কমছে। এটাও মানিয়ে নিচ্ছি। জোর দিয়ে বলছি আমার আয় বাড়ছে। বায়ুদূষণে শ্বাস নেওয়া কঠিন। তবুও চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে যক্ষ্মায় মৃত্যু কমেছে। রাস্তায় কালো ধোঁয়ার গাড়ি চলছে। জরিমানা করলে ভাড়া বাড়িয়ে সেটা তুলে নিচ্ছে। রাস্তায় ধুলার আস্তর। তার ওপর দিয়ে গাড়ি গেলে চারদিক ধুলায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে এত উচ্চ শব্দের হর্নের প্রয়োজন নেই। আবার যানজটের মধ্যে হর্ন বাজালেও লাভ নেই। তবুও নিজের প্রভাব দেখানোর জন্য বাজাচ্ছি। আইন আছে। কিন্তু এই জনবহুল শহরে কে তা বাস্তবায়ন করবে? আমাদের মতো মানুষই তো সরকার। কোনো আইন করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক চিন্তা করা দরকার যে, বাস্তবায়ন করতে পারব কি না। অন্যথায় আইনটা গুরুত্বহীন হয়ে যায়, যা সার্বিকভাবে আইনি ব্যবস্থার ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।