হিন্দি ছবিতে ‘খান’ হলো জনপ্রিয়তার প্রতীক। তিন খানের দাপটে বলিউড মাতোয়ারা তিন দশকের বেশি সময়। বলা হয়, বলিউডে খান রাজত্ব চলছে।
হিন্দি সিনেমার ব্যবসা, সাফল্য, ব্যর্থতার নিয়ামক হলো ‘খান’। বলিউডের আদলেই বাংলাদেশে খান রাজত্ব কায়েম হয়েছিল আওয়ামী জমানায়। এই খান অবশ্য নায়ক না, ‘খলনায়ক’। তাকে বলা হতো ‘মাফিয়া খান’। তিনি ছিলেন অপরাধী, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদার। সারা দেশে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল ছিলেন এই খান। তিনি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তার নেতৃত্বে সারা দেশে আওয়ামী লীগের এমপি এবং মাফিয়ারা হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। সবাই যেন নিজ নিজ এলাকায় মাফিয়া এবং সন্ত্রাসী রাজত্ব তৈরি করেছিল। আর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। জেলায় জেলায় এমপিদের নেতৃত্বে ছিল সন্ত্রাসী বাহিনী, মাদক বাহিনী, কিশোর গ্যাং। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাছে ছিল অসহায়। একেক এলাকায় একেকজন হয়ে উঠেছিলেন গডফাদার। আর সারা দেশে গডফাদারদের সর্দার ছিলেন কামাল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ১০ বছরের বেশি সময়ে আসাদুজ্জামান খান সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, অপরাধীদের লালন করেছেন। সাধারণ মানুষের ওপর করেছেন জুলুম-নির্যাতন।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কথাই ধরা যাক। সেখানে এমপি গাজী গোলাম দস্তগীরের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল মাফিয়া রাজত্ব। রূপগঞ্জ নামই যেন পাল্টে ‘গাজীগঞ্জ’ হয়ে উঠেছিল আওয়ামী রাজত্বে।
১৫ বছরে ‘রূপগঞ্জ’ যেন একখণ্ড বাংলাদেশ। সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের চিত্র। এসবই ঘটেছে সাবেক মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীরের পৃষ্ঠপোষকতায়।
স্থানীয়রা বলছেন, গাজীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দুঃসাহস দেখালে ভাগ্যে জুটত মামলা, হামলা আর শারীরিক নির্যাতন। জমি দখল ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে খুন-গুমের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ উঠে আসছে তার বিরুদ্ধে। আর এসবে মদত দিতেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিনিময়ে তিনি পেতেন বস্তাভর্তি শত শত কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রূপগঞ্জের কেয়ারিয়া, পর্শি, বাড়িয়াছনি, কুমারপাড়া এলাকায় কয়েক শ হিন্দু পরিবারের বসবাস। সেখানকার ৮০ শতাংশ হিন্দু মানুষের জমি জিপার্ক (গাজীপার্ক) নামে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করে বালু ভরাট করেন গাজী গোলাম দস্তগীর। জিপার্কের এ জায়গা জবরদখলের দায়িত্বে ছিলেন বাঘবেড় সিটি মার্কেট এলাকার ভূমিদস্যু ইমন হাসান খোকন।
জানা গেছে, খোকন গাজী ছিলেন বিশ্বস্ত ভূমিদস্যুদের একজন। নামমাত্র মূল্যে জমি বিক্রি করতে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করেন তিনি। বিক্রি না করলে জাল দলিল তৈরি করেন। এ চক্র সর্বোচ্চ দেড় শ বিঘা জমি কিনে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ বিঘা জমি দখল করে রেখেছে। যার প্রতি শতাংশের মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। প্রতিবাদ করলে পালিত সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ভুক্তভোগীদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর করে উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। খোকনের বাবা একসময় মাটি কাটার কাজ করতেন। গাজীর সংস্পর্শে তারা এখন শত কোটি টাকার মালিক। এসব নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করলে ফল হতো উল্টো। অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধেই পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হতো। রূপগঞ্জের খাদুন এলাকায় গড়ে তোলা হয় গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি। এ ফ্যাক্টরির প্রায় ৮০ শতাংশ জমিই জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে। আয়েত আলী ভুঁইয়ার ছেলে হাজি আমজাদ আলী ভুঁইয়ার ১৯ বিঘা ৮ শতাংশ, হাজি আবদুল হাইয়ের চার বিঘা, মোবারক হোসেনের দেড় বিঘা, আবদুল বারী ভুঁইয়ার দুই বিঘা, নূর মোহাম্মদের এক বিঘা, ইসমাইল খাঁর চার বিঘা, সিরাজ খাঁর চার-পাঁচ বিঘা, শাহ আলমের প্রায় ৭০ শতাংশ, জুলহাস ভুঁইয়ার ৭১ শতাংশ ও আপেল মাহমুদের আড়াই বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে খাদুনে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি তৈরি করা হয়েছে। তারা থানায় অভিযোগ করেও ফল পাননি। কারণ থানায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা ছিল- গাজীর কথার বাইরে কিছুই করা যাবে না।
পাশা গ্রুপের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন, এ ফ্যাক্টরির স্টাফ কোয়ার্টার বানানো হয়েছে পাশা গ্রুপের ১৩৯ শতাংশ জমির ওপর। পাশা গ্রুপের পাঁচ তলা ভবনসহ জমি দখলের অভিযোগে গাজীর বিরুদ্ধে মামলাও করে পাশা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানের জমি রক্ষা করতে গিয়ে নির্মম হামলার শিকার হন খোরশেদ আলম। তিনি আয়েত আলী টেক্সটাইলের কেয়ারটেকার। জমি দখলের প্রতিবাদ করায় কুপিয়ে জখম করা হয় তাকে। মাথায় ২৬টি সেলাই করতে হয়েছিল তার। কিন্তু এসবের কোনো প্রতিকার করেননি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রূপগঞ্জ যেন গাজীকে ইজারা দিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান খান।
আওয়ামী লীগের পদ এবং মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার বিরাব, কাঞ্চন, ভালুকাব, টেংরারটেক, পোনাব, আমলাব, কেশরাব, আধুরিয়া, পূর্বগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় দেড় হাজার বিঘা হিন্দু-মুসলিমের মালিকানা জমি ও খাসজমি দখলে নিয়েছেন গোলাম দস্তগীর গাজী ও তার ছেলে পাপ্পা।
শুধু জমি দখলই নয়, মাদক ব্যবসা এ এলাকায় বড় সমস্যা। তাতেও আছে গাজীর নিয়ন্ত্রণ। ধর্ষণ এবং খুনের পেছনেও রয়েছে এই বাহিনী। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র আর মাদকের ডিপোতে পরিণত হয়েছে রূপগঞ্জ। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করেন মন্ত্রীপুত্র পাপ্পা ও মন্ত্রীর এপিএস দাদা এমদাদ। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে রূপগঞ্জকে তিনি পরিণত করেছেন গাজীগঞ্জে। সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে গঠিত হয়েছিল এমপির গাজী লীগ বাহিনী। এলাকাবাসীও বলছেন, গাজীর সন্ত্রাসী বাহিনী রূপগঞ্জকে রীতিমতো অপরাধের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছে। সেটা সম্ভব হয়েছিল সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কারণে। আসাদুজ্জামান খান ছিলেন টাকার কাঙাল। গাজী টাকা দিয়েই তাকে বশীভূত করেছিলেন। শুধু গাজী একা নন, সারা দেশে এভাবেই সন্ত্রাসীদের মদদ দিতেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রতিটি আওয়ামী লীগের এমপিই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় এভাবেই দানবে পরিণত হয়েছিলেন। দেশের আইন নয়, এমপিদের আইনে চলত এলাকা। আসাদুজ্জামান খানের কাজ ছিল এমপিদের কাছ থেকে বস্তাভর্তি টাকা নেওয়া। টাকা পেলেই সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চোখ বন্ধ রাখতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যেমন, গাজীর সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে ছিল কালাদি গ্রামের শাহীন ওরফে লোহা শাহীন। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও ইয়াবা ব্যবসার জন্য সবাই এক নামে চেনে তাকে। রূপগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। আছে একই গ্রামের আনিসুর রহমান খোকন। রূপগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধেও আছে দুটি মামলা। মাছিমপুর গ্রামের মো. নোমান। সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে তার বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলা আছে। বাহিনীর সদস্য রাকিব ওরফে গুই রাকিবের বিরুদ্ধে আছে চারটি মামলা এবং একটি সাধারণ ডায়েরি। আরেক সন্ত্রাসী লাল মিয়ার ছেলে হামিদের বিরুদ্ধেও আছে একটি মামলা। কেন্দুয়াটেক এলাকার মতিউরের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় পাঁচটি মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ আছে। মাছিমপুরের আরেক সন্ত্রাসী রনি। তার বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় চারটি মামলা আছে। চরপাড়ার মতিনের বিরুদ্ধে আছে তিনটি মামলা। মাছিমপুরের মামুনের নামে আছে চারটি মামলা। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ইয়াবা ব্যবসার তথ্য জানা গেছে। আলমাসের বিরুদ্ধেও আছে মাদক বাণিজ্যের অভিযোগ। রূপগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে।
কালাদি গ্রামের আলী বান্দার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জুয়ার অভিযোগে একটি মামলা রয়েছে। মাছিমপুরের ফরিদের বিরুদ্ধে আছে চারটি মামলা। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বহু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তাওলাদ মেম্বারের নামে আছে অসংখ্য অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় সাতটি মামলা, একটি জিডি এবং সোনারগাঁ থানায় একটি মামলা রয়েছে। এরা সবাই এলাকায় গাজী বাহিনীর সদস্য। অথচ এরাই ছিল সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছের মানুষ।
চনপাড়ায় মন্ত্রী গাজীর শীর্ষ সন্ত্রাসী হলো শমসের আলী খান ওরফে ডাকু শমসের। হাসমত আলী ওরফে হাসমত দয়ালের ছেলে ডাকু শমসেরের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। মাদক ব্যবসা, অস্ত্র, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, লুটপাটসহ বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। রূপগঞ্জ থানায় রয়েছে ১৫টি মামলা। গোলাকান্দাইল ইউনিয়নেও রয়েছে মন্ত্রী গাজীর সন্ত্রাসী বাহিনী। এদের মধ্যে আছে গোলাকান্দাইল দক্ষিণপাড়ার নূর আলম ওরফে ডাক্তার নূর আলম, মোহাম্মদ শফিউল্লাহ মোল্লা, গোলাকান্দাইল নাগেরবাগের মোহাম্মদ বিদ্যুৎ, আকাশ নিলয়, গোলাকান্দাইল নতুন বাজারের হানিফ মিয়া, পনির মিয়া, তানভীর, মাসুদ মিয়া, রাজু, গোলাকান্দাইল কবরস্থান এলাকার মাসুম বিল্লাহ, গোলাকান্দাইল উত্তরপাড়ার সৌরভ চৌধুরী ও সিয়াম চৌধুরী, সিংলাবোর ইমরান হোসেন, কামাল হোসেন, বলাইঘার আলামিন ও ফয়সাল। কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কারণে এসব সন্ত্রাসী ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। রূপগঞ্জ একটি উদাহরণ মাত্র। আসাদুজ্জামান খানের কাছে টাকাই ছিল সব। টাকার জন্য সন্ত্রাসীরা ছিল আসাদুজ্জামানের প্রিয়ভাজন। এভাবেই গোটা দেশকে সন্ত্রাসী, মাদকাসক্তদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন খান। আওয়ামী লীগ আমলে যে সন্ত্রাস ও মাদক ব্যবসার অবাধ বিস্তার হয়েছিল, তার একটি উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। সারা দেশের চিত্রই ছিল এমন। অপরাধীদের আদর আপ্যায়নে রাখতেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। কারণ তারাই ছিল তার টাকার খনি।