রাজপথ নয়, যেন মরণফাঁদ। যে কোনো মৃত্যুই বেদনাদায়ক। তবে সে মৃত্যু যদি হয় দুর্ঘটনায় তাহলে বেদনার মাত্রাটা হয় আরও করুণ। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেন নৈমিত্তিক। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরে পড়ছে বহু তাজা প্রাণ। ঘর থেকে বের হয়ে গন্তব্যস্থলে না পৌঁছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে লাশ হয়ে ফিরছে অনেকে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অনেকে, পঙ্গুত্ববরণ করেছে অসংখ্য মানুষ। সেসব পরিবারের দুর্বিষহ জীবনের দায় নেই কারও! আর একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটি মরে গেলে শুধু প্রিয়জন হারানোর বেদনা নয়-সেই পরিবারের প্রতিদিনের দুঃখ বেদনায় সমাজ ও রাষ্ট্র কেবলই দর্শক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, যানবাহনের যান্ত্রিক ক্রটি, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন, গাড়ির প্রতিযোগিতা, রাস্তার দুরবস্থাসহ নানা কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পদ্মা সেতু উত্তর থানার সামনে তিনটি বাস, জিপ, প্রাইভেট কার ও অটোরিকশার সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঢাকা অভিমুখী ইমাদ পরিবহনের একটি বাস ব্রেক ফেল করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে একটি প্রাইভেট কারকে ধাক্কা দেয়। এরপর একে একে জিপ ও দুটি বাসকে ধাক্কা দেয়। আবার ইমাদ পরিবহনের ধাক্কায় ইলিশ পরিবহনের একটি বাস উঠে পড়ে একটি অটোরিকশার ওপর। এতে অটোরিকশাটি দুমড়েমুচড়ে যায় এবং চালক গুরুতর আহত হন। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয়রা ও পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠান। ১০ জুলাই ১১টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে পেছন থেকে এসে বেপরোয়া গতির বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন মোটরবাইকের আরোহী এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। তার নাম মেহেরুন্নেসা ঝুমি (২২)। তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। দুর্ঘটনায় আহত হন তার স্বামী মুসা কালিমুল্লাহ (২৬)। কালিমুল্লাহ-মেহেরুন দম্পতির চার বছরের একটি কন্যাসন্তান আছে। আহত অপর বাইকের আরোহী রানা (২৫) আহত হয়েছেন। রানার অবস্থা আশঙ্কাজনক। স্থানীয়রা মঞ্জিল পরিবহনের বাসটিকে আটক করেছে। একই দিন (১০ জুলাই ভোরে) কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের মনোহরগঞ্জের বড়কাঁচি এলাকায় বাসচাপায় বেল্লাল হোসেন নামে এক প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি ফজরের নামাজ শেষে মরহুম বাবা আবদুল খালেকের কবর জিয়ারত করে মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় ঢাকাগামী একটি যাত্রীবাহী বাস একটি মালবাহী ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে তাকে চাপা দেয়।
৮ জুলাই ভোরে সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের চড়িয়া মধ্যপাড়া এলাকায় ট্রাকচাপায় মৃত্যু হয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার যাত্রী বাবা ও ছেলের। অটোতে থাকা বড় ছেলে আহত হয়েছে। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে দুই ছেলে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। ৭ জুলাই দুপুরে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে ঢাকা-জামালপুর মহাসড়কের বাঘিল এলাকায় বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে মা-ছেলেসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আরও একজন আহত হন। ৪ জুলাই ভোরে পাবনার সাঁথিয়ায় পাবনা-ঢাকা মহাসড়কের পূর্ব বনগ্রাম এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও পাথরবোঝাই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। এভাবে প্রায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলছে দুর্ঘটনা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুন মাসে সারা দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৭৪৩টি দুর্ঘটনায় ৭৮০ জন নিহত এবং ১ হাজার ৯১৬ জন আহত হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, জুন মাসে দেশে মোট ৬৮৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৯৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৮৬৭ জন আহত হয়েছে। আর্থিক মূল্যে মানবসম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৪৬৩ কোটি ২০ লাখ টাকার মতো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে সারা দেশে ২ হাজার ৪৮২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২ হাজার ৩৭৭ জনের মৃত্যু এবং ২ হাজার ৮২২ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাধারণত সড়কের ধারে বাজার ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানোকে দায়ী করেছেন। একই সঙ্গে রাস্তা নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জেব্রা ক্রসিং না থাকা এবং জেব্রা ক্রসিং গাড়িচালক কর্তৃক না মানা, অরক্ষিত রেলক্রসিং, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করে কথা বলা, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যান চলাচল, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো এবং মহাসড়ক ক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন উঠে যাওয়াকেও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিষেজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার কারণে বছরে জিডিপির দেড় থেকে ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দায়ী করলে চলবে না। পরিবহন মালিক-শ্রমিক, হাইওয়ে পুলিশ ও বিআরটিএকে যৌথভাবে দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থায় নিয়োজিত অসংখ্য অদক্ষ চালক ও হেলপার, পরিবহন ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে দিনদিন বেড়েই চলছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা। দুর্ঘটনায় দোষীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ। সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি বহুমাত্রিক। এখানে ট্রাফিক এনফোর্সমেন্টের পাশাপাশি আরও নানা বিষয় জড়িত। আইন বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট অংশে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এ ছাড়া জনসচেতনতা তৈরিতেও পুলিশ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের রোড সেফটি প্রকল্প সমন্বয়কারী শারমিন রহমান জানান, বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় গতির কারণে। তাই সড়ক পরিস্থিতির কথা ভেবে নিরাপদ গতি নির্ধারণ করা উচিত। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, গাড়ির নিবন্ধন, ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।