মশা মারতে কামান দাগিয়েও যেন মিলছে না মুক্তি। প্রতি বছর মশাবাহিত রোগে প্রাণ হারাচ্ছে অগণিত মানুষ। শুধু ডেঙ্গুতেই ২০২৩ সালে দেশে মারা গেছে ১ হাজার ৭০৫ জন। আক্রান্ত হন তিন লক্ষাধিক। চলতি বছরে ২৬ জুন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ৩৮ জনের। জুনেই আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার মানুষ। মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়াসিস, জিকা ভাইরাস, জাপানিজ এনসেফালাইটিস রোগগুলোও কম ভোগাচ্ছে না। সরকার প্রতি বছর মশা মারতে হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও ফলাফল শূন্য। উল্টো কীটনাশকে ক্ষতির মুখে জীববৈচিত্র্য। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা আশার আলো দেখাচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশি আরঅ্যান্ডডি প্রতিষ্ঠান থিংক ল্যাবের উদ্ভাবিত মশার মেশিন। কোনো কিটনাশক ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মশা মেরে মেশিনটি মশা গবেষকদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা বিশ্বের প্রায় সব ধরনের মশার ফাঁদ পরীক্ষা করেছি। তার মধ্যে থিংকের ফাঁদটি সবচেয়ে সেরা মনে হয়েছে। আমরা গবেষণার জন্য এক বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার পাঁচটি স্থানে থিংকের মেশিনটি বসিয়ে মশা সংগ্রহ করেছি। তাতে দেখা গেছে, প্রতিটি যন্ত্রে দৈনিক ৫ হাজারের মতো স্ত্রী মশা (মৃত) জমা হয়। এই যন্ত্রের সুবিধা হলো, এটি মা মশা আটকায়। প্রতিটি মা মশা ৫০০ থেকে ৬০০ ডিম দেয়। অর্থাৎ, এই যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মশার সংখ্যা ও বংশবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন রাজধানীর উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের পার্কে গিয়ে দেখা মেলে এমন একটি মেশিনের। মেশিনের মধ্যে ঘুরছে ফ্যান। তার ওপরে নীল আভার একটি বাতি জ্বলছে। নিচের চেম্বারে জমা হয়েছে অসংখ্য মশা। পরে উত্তরার জসিমউদ্দীনে থিংকের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শুধু মশার মেশিনই নয়, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নানা প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দিন-রাত কাজ করছেন একঝাঁক তরুণ গবেষক। বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন নির্গমনের পাশাপাশি সুপারফুড শৈবাল চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের শেষ প্রান্তে আছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রচণ্ড গরমে শরীরে এয়ার কন্ডিশনারের অনুভূতি দেবে এমন জ্যাকেট উদ্ভাবনও চলমান রয়েছে। নয়েস মনিটরিং ডিভাইস, সার্বক্ষণিক ভ্যাকসিনের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের জন্য তারহীন সেন্সর, স্বল্পমূল্যে আইপিএস, গ্যাসের সরবরাহ লাইনের তদারকি, জেনারেটরের ডিজেল পরিমাপ, হাইড্রোফোনিক উদ্ভিদের স্বয়ংক্রিয় তদারকিসহ নানান কাজের জন্য সেন্সর বানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
মশার মেশিন প্রসঙ্গে থিংক ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আশিকুর রহমান তানিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মশা কামড়ানোয় তার ছেলেকে চারবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। বাসায় ফগার মেশিন পর্যন্ত কিনেছিলেন। কিন্তু কাজ হয়নি। এতে মশা মরে না। এ ছাড়া ফগার মেশিনের বিষাক্ত ধোয়ায়ও সমস্যা হতো। কারণ, এটা তো এক ধরনের বিষ। তখন তিনি মশা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। আড়াই বছরের চেষ্টায় মশার মেশিন উদ্ভাবনে পান সফলতা।
আশিকুর তানিম জানান, মূলত স্ত্রী মশাই মানুষকে কামড়ায়। প্রজণনের জন্য তাদের রক্তের প্রয়োজন। আর নিশ্বাসের মাধ্যমে বের হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইডকে অনুসরণ করে প্রাণীদেহের কাছে পৌঁছায় মশা। এ কারণে থিংক ল্যাবের উদ্ভাবিত মশার মেশিনে মানুষের নিঃশ্বাসের কৃত্রিম আবহ তৈরি করা হয়। এতে আকর্ষিত হয়ে স্ত্রী মশা ট্রাপে আটকা পড়ে। মেশিনে থাকা সাকশন ফ্যানের কারণে মশা আর বের হতে পারে না এবং পানিশূন্যতায় মারা যায়। এটি ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ দিয়ে চালিয়ে রাখতে হয়। তবে বিদ্যুৎ খরচ খুবই কম। সৌরশক্তির মাধ্যমেও মেশিনটি চালানো সম্ভব। তিনটি আকারের মেশিন তৈরি করা হয়েছে। আকারভেদে দাম ৩১ হাজার থেকে ৮০ হাজার। তবে বেশি পরিমাণে উৎপাদনে যেতে পারলে দাম কমে আসবে। এ ছাড়া এটা একবার বিনিয়োগ করে ৭-৮ বছর সামান্য রক্ষণাবেক্ষণ খরচেই পরিচালনা সম্ভব।
তিনি বলেন, সব কীটনাশকে সব মশা মরে না। আবার সব এলাকায় একই মশার উপদ্রব থাকে না। তাই অনেক সময় জায়গা ভেদে মশার ওষুধ কার্যকর না-ও হতে পারে। তবে মেশিনে সব ধরনের স্ত্রী মশা আকর্ষিত হয়ে আটকা পড়ে। আবার মৌমাছির মতো উপকারী পোকা-মাকড় আটকাতে দেখা যায়নি।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ব্যাংক, বিভিন্ন বাহিনী, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঁচ তারকা হোটেল, রিসোর্ট, বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরসহ অর্ধ শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মশার মেশিনটি নিয়েছে। প্রথমে দুয়েকটি মেশিন নিয়ে পরীক্ষা করেছে, পরে আরও নিয়েছে।
এদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেই মশক নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ করা হয় ১১০ কোটি টাকা। দক্ষিণ সিটিতে শুধু মশার ওষুধ কিনতে ব্যয় ধরা হয় ৪০ কোটি টাকা। রয়েছে যন্ত্রপাতি ক্রয়, পরিবহন, জনবলের পেছনে ব্যয়। তবুও প্রতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ঢাকায়। জানা গেছে, এবার মশা ঠেকাতে থিংকের মশার মেশিন যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে দুই সিটি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, মশা প্রতিরোধে আমরা বহুমাত্রিক পরিকল্পনা করছি। তাতে মশার মেশিন স্থাপনের বিষয়টিও ভাবছি। থিংকের মেশিনটির রিভিউ ভালো। একটা প্রস্তাবও পেয়েছি। এটা কাজে লাগানো হবে।