১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১১ প্রজাতির রয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণী। শুধু গণ্ডার বিলুপ্ত হয়েছে তিন প্রজাতির। সবচেয়ে বেশি (১৯ প্রজাতির) বিলুপ্ত হয়েছে পাখি। হারিয়ে গেছে সরীসৃপের একটি প্রজাতি।
একসময় দেশের সব বনাঞ্চলে এমনকি কিছু গ্রামাঞ্চলে দেখা মিলত বাংলার বাঘের। ১৯৬২ সালে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় শেষ বাঘটিকে গুলি করার পর গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বেঙ্গল টাইগার সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়।
নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ ঠাঁই নিচ্ছে রাজধানীর ফুটপাত ও বস্তিতে। অনেকের জমিসহ ঘর তুলে দিচ্ছে সরকার। কিন্তু বন ধ্বংসের কারণে আবাসস্থল হারানো প্রাণীগুলোর ঠাঁই হচ্ছে না কোথাও। তারা চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। বনবিভাগ ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১১ প্রজাতির রয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণী। শুধু গণ্ডার বিলুপ্ত হয়েছে তিন প্রজাতির। বাংলাদেশের ১৬১৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে ২০১৪-১৫ সালে সমীক্ষাটি করা হয়। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি (১৯ প্রজাতির) বিলুপ্ত হয়েছে পাখি। হারিয়ে গেছে সরীসৃপের একটি প্রজাতি। আবাসস্থল ধ্বংস, বন উজাড়, জলাভূমি ও চারণভূমি হারানো, পানি ও বায়ুদূষণ, কীটনাশকের ব্যবহার, চোরাশিকারির দৌরাত্ম্য, জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাওয়াকেই বণ্যপ্রাণী বিলুপ্তির মূল কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়।
বাংলার বাঘের সুনাম বিশ্বজুড়ে। দেশের সবচেয়ে পরাক্রমশালী স্তন্যপায়ী প্রাণী এই রয়েল বেঙ্গল টাইগার। একসময় দেশের সমস্ত বনাঞ্চলে এমনকি কিছু গ্রামাঞ্চলের ঝোপঝাড়েও দেখা মিলত প্রাণীটির। ১৯৬২ সালে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় শেষ বাঘটিকে গুলি করার পর গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বেঙ্গল টাইগার সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এখন এই প্রজাতিটি টিকে আছে শুধু সুন্দরবনে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘনঘন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, বন তলিয়ে যাওয়া ও চোরাশিকারির দৌরাত্ম্যে হুমকিতে রয়েছে পশুটি। ২০২৩-২৪ সালের গণনা অনুযায়ী পুরো বনে এখন টিকে আছে ১২৫টি বাঘ।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকলেও বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে ডোরাকাটা হায়েনা, ধূসর নেকড়ে, নীলগাই, বান্টেং বা বনগরু, বুনোমহিষ, দুই শিংওয়ালা সুমাত্রা গণ্ডার, জাভা গণ্ডার, ভারতীয় গণ্ডার, জলার হরিণ, কৃষ্ণমৃগ বা কৃষ্ণসার হরিণ ও শ্লথ ভালুক। এক সময় সুন্দরবনের উত্তর অংশে বিচরণ ছিল তিন প্রজাতির গণ্ডারের। বর্তমানে গণ্ডারশূন্য সুন্দরবন।
গণ্ডার : সুন্দরবনের উত্তরাংশে একসময় সুমাত্রা গণ্ডার (এশিয়ার দুই শিংওয়ালা গণ্ডার), জাভা গণ্ডার ও ভারতীয় গণ্ডারের বিচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৩০ সালের পর সুন্দরবনে এর কোনো প্রজাতির গণ্ডারেরই আর দেখা মেলেনি। সর্বশেষ খুলনার রায়সাহেব নলিনীকান্ত রায়চৌধুরী ১৮৮৫ সালে সুন্দরবনে জাভা গণ্ডারের পায়ের ছাপ পাওয়ার দাবি করেন। শিং আর মোটা চামড়ার লোভে নির্বিচারে গণ্ডার শিকারের কারণে এরা ধীরে ধীরে এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলার বারো ভূঁইয়াদের রাজা প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদের বর্মও সুন্দরবনের গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হতো। জাভা গণ্ডার শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্ব থেকেও বিলুপ্তির দোরগড়ায়।
ডোরাকাটা হায়েনা : বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে দেখা যেত এই হিংস্র স্তন্যপায়ী প্রাণীটির। ঝোপঝাড় কেটে বসতভিটা তৈরি, বনভূমি ধ্বংস, পিটিয়ে মেরে ফেলা ও খাদ্য সংকটে বিশ শতকে প্রাণীটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় বলে মনে করা হয়।
ধূসর নেকড়ে : যথেষ্ট গাছপালা আছে এমন অধিকাংশ এলাকাতেই এই নেকড়ের দেখা মিলত। রাতে শোনা যেত নেকড়ের ডাক। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে প্রাণীটির আর দেখা মেলেনি।
নীলগাই : সত্তর-আশির দশকের শিশুরা নানি-দাদিদের মুখে নীলগাইয়ের গল্প শুনে বড় হয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের বনে দেখা মিলত প্রাণীটির। অনেক দিন পানি না খেয়ে বাঁচতে পারে। তবে সুস্বাদু মাংসের কারণে সব সময় শিকারির তিরের নিশানায় ছিল নীলগাই। ১৯৩০ সালের পর আর দেখা মেলেনি প্রাণীটির।
বান্টেং বা বনগরু : চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ি বনে দেখা মিলত এই গরুর। বন ধ্বংসে ও শিকারির কবলে এই প্রাণীটিও হারিয়ে গেছে। ১৯৪০ সালের পর দেশের কোথাও আর বনগরুর দেখা মেলেনি।
বুনো মহিষ : এ প্রজাতিটিও দেখা যেত চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ে। দল বেঁধে ঘুরে বেড়াত এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। ১৯৪০ সালের পর এই মহিষের আর দেখা যায়নি।
বারশিঙ্গা বা জলার হরিণ : এ হরিণ গায়ে সুন্দরবনের চিত্রা হরিণের মতো ছোপ ছোপ দাগ ছিল না। আকারে চিত্রা হরিণের চেয়ে কিছুটা বড় হতো। সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা মিলত। ১৯৫০ সালের পর আর এ হরিণের দেখা মেলেনি।
কৃষ্ণসার হরিণ : বলিউড সুপারস্টার সালমান খান ফেঁসে গিয়েছিলেন কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার অপরাধে। এক সময় দেশের উত্তরাংশে দেখা মিলত এই কৃষ্ণসারের। এ হরিণের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় যে কেউ। খাড়া দুটি শিং, সাদা পেট, ধূসর বা কালো পিঠ, মায়াবি চোখ পাথরের মতো মনকেও গলিয়ে দিতে সক্ষম। তবুও হরিণটি টিকে থাকতে পারেনি। আবাসস্থল ধ্বংস ও চোরাশিকারির হিংস্রর বলি হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কৃষ্ণসার হরিণ।
শ্লথ ভালুক/ মধু ভালুক : চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ছিল এই ভালুকের বিচরণ। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রাণীটি হারিয়ে গেছে।