চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মেয়ে আফরোজা সুলতানা রত্না। যিনি চলচ্চিত্রে এসে হয়ে গেলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবানা।
প্রবাদ আছে ‘চট্টগ্রামের মেয়েরা ভালো রাঁধতে পারে। তাঁদের রান্নার সুনাম দুনিয়াজোড়া।’ চট্টগ্রামের মেয়ে হিসেবে অভিনেত্রী শাবানার ক্ষেত্রেও একই প্রশংসা। তিনি যেমন দক্ষ অভিনয় করে গেছেন তেমনি সুদক্ষ রাঁধুনিও বটে। দীর্ঘদিন আমেরিকা প্রবাসী হলেও মাঝেমধ্যে মাতৃভূমিতে আসেন। তখন কাছের মানুষজনকে নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করান শাবানা। তাঁর হাতে রান্না করা সুস্বাদু খাবার খেয়ে সবাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। আমারও সেই সৌভাগ্য হয়েছিল কয়েকবার। সম্প্রতি মুঠোফোনে রান্না নিয়ে কথা হয় কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানার সঙ্গে। তাঁর রান্নার প্রশংসা করে এ প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, আমি মোটামুটি একা একাই রান্নার সব কাজ করতে অভ্যস্ত। কাজের মানুষের ওপর কখনই পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলাম না, আগেও না, এখনো না। আমি সব সময়ই খাবারের ব্যাপারে খুব কেয়ারফুল থাকি। আমি নিজেও যেমন খেতে পছন্দ করি, অন্যকে খাওয়াতে আরও বেশি পছন্দ করি। কিন্তু এর অর্থ এই নয়, আমি খুব ভালো রাঁধুনি।
শাবানা বলেন, আমার বাসায় গেস্ট এলে মোটামুটি আমি একাই সব রান্না করি। আমার বাসার একটা নিয়ম, সবাই সকাল ৮টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে খেতে বসে যাবে। আর যদি বাসায় গেস্ট আসে, তবে সেদিন সবাই পারলে ভোর ৬টায় খেতে বসে যায়। গেস্টদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই নানাজন হরেক রকমের নাশতা করে। কেউ পরোটা, কেউ শুকনো রুটি, কেউ নরম খিচুড়ি, কেউ ঝরঝরে খিচুড়ি, আবার কেউ কেউ নরম ভাত আর আলুভর্তা। এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আরও হরেক রকমের ফর্দ থাকে : কেউ ডিম অমলেট খাবে তো কেউ ভাজি, আবার কেউ শুধু পিঁয়াজ দিয়ে ডিম ভাজি, কেউ শুধু মরিচ দিয়ে ডিম ভাজি, কেউ আবার পিঁয়াজ-মরিচ ছাড়া শুধু লবণ দিয়ে ডিম ভাজি। এর সঙ্গে দুই রকমের মাংস, বেগুন ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, কচুরপাতা ভর্তা, লাউপাতা ভর্তা... এরকম বাহারি মুখরোচক নানান আইটেম।
শাবানার কথায়, তারও পরে কেউ হয়তো কোনো একটা আইটেম খেতে বসে সব আইটেম একটু একটু করে খেয়ে সব কিছু এক করে মিলিয়ে পাতে নেয়, এ জন্য আমি সব কিছুই পর্যাপ্ত পরিমাণে রান্না করি। এ তো গেল খাবারদাবারের গল্প। কিন্তু খাবারের পর কে কেমন তৃপ্তি পেলেন তা তারা ইনিয়েবিনিয়ে বলতে শুরু করে দেন, কোনটা কার কাছে কতটা মজা লেগেছে কিংবা কোন আইটেমটা আরেকটু ভালো হলে কেমন বেশি মজা হতো। এমন আরও কত কী? তাদের এমন সব মন্তব্য আমি দারুণভাবে উপভোগ করি। কারণ আমি মনে করি, আমার রান্নার সমৃদ্ধির জন্য এসব আলোচনা খুবই উপকারী।
শাবানা বলেন, একে তো একা একা এত কিছু রান্না করি, তার ওপর এত ধরনের ফর্দ মাফিক রান্না করেও যদি কেউ বলে অন্য কেউ কেমন করে রান্না করত, সেটা খেতে কেমন হতো, এটার সেটার পার্থক্য কী কী, সেসব শুনতে হয় তাহলে সত্যিই আরেক বেলা এসব মানুষকে কিছু রান্না করে খাওয়াতে একটুও রুচিতে আসে না। তা ছাড়া রান্না জিনিসটা সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। যত বেশি কারও রান্নার খুঁত ধরবে, ততই সে সামনেরবার আরও বিশ্রী করে রান্না করবে এবং এর বিপরীতটাও সমভাবে প্রযোজ্য। যদি নিজের পছন্দের খাবারের কথা বলি তাহলে বলব, একেবারে খাঁটি বাঙালি আবার বলতে যা বোঝায় তা-ই আমার প্রিয়। দীর্ঘদিন প্রবাসে জীবনযাপন করছি। বলতে পারেন আমার খাবার আমি নিজ হাতে রেঁধে খাই। কারণ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আমার জন্ম। মানে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। সেখানে মেজবানের রান্না, গরুর কালিভুনা, সামুদ্রিক নানা মাছ, শাকসবজি আর শুঁটকি মাছ তো আছেই। সব কিছুই রাঁধতে আমি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এখনো নিজে এসব রেঁধে খাই, সবাইকে খাওয়াই। শাবানার কথায়, আমি কিন্তু ঘটা করে রান্না শিখতে পারিনি। কারণ খুব ছোট বয়সে চলচ্চিত্রে চলে এসেছি। তাই ফিল্মি ক্যারিয়ারের ব্যস্ততার মাঝে মা অথবা কারও কাছ থেকে রানা শেখাটা হয়ে ওঠেনি। ১৯৭৪ সালে বিয়ের পর নিজের অনুমান আর সাহসে বলতে গেলে নিয়মিত রাঁধতে শুরু করি। আমার সৌভাগ্য, রান্নার শুরুতেই সবার প্রশংসা ভাগ্যে জুটে যায়। এতে আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে গেলে একসময় আরও ভালো রাঁধার চেষ্টাটা আমার মধ্যে বেড়ে গেল।
শাবানা বলেন, রান্না নিয়ে বলতে গেলে সবশেষে আরও কটি কথা বলতে হয়, আমি মনে করি অন্যদেরও এই কথাগুলো মনে রাখা দরকার। যেমন- আমার কখনো কারও রান্না নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকে না। আমি একদম সবই খাই, মানে আমার খাওয়া নিয়ে কোনো ধরনের বাছাবাছি নেই। যে রান্না করে, আমি এই পর্যন্ত তার রান্না নিয়ে কখনো বাজে কিছু বলিনি। রান্না ভালো লাগলে আমি অবশ্যই ডেকে প্রশংসা করি। এমনকি সে যদি নিজে কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করে, রান্না কেমন হলো, আমি ভালো না হলেও বলি, হ্যাঁ, রান্না ঠিকঠাক। আমার এমন রেকর্ডও আছে, রান্নায় লবণ হয়নি, কিন্তু আমি স্বাভাবিকভাবেই খাবারটি খেয়ে নিয়েছি। আমার চোখে, রান্না পৃথিবীর মহত্তম শিল্প। এসব কথা মনে রাখলে একজন ভালো রন্ধনশিল্পী হওয়ার পথে আর কোনো ধরনের বাধা থাকে না।