ধর্ষণ জিনিসটা আগে ছিল না এমন নয়। ছিল; তবে সীমিত পরিমাণে। গণধর্ষণের এবং শিশুধর্ষণের খবর পাওয়া যেত না। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নির্বিচারে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ শুরু করে। মার খেয়ে এবং লেজ গুটিয়ে তারা পালিয়েছে; কিন্তু গণধর্ষণ থামেনি; বরং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মহামারিই বলা যায়। সঙ্গে ঘটছে শিশুধর্ষণ, আগে যা অকল্পনীয় ছিল। লিখতে লিখতে কয়েকটি ঘটনার খবর জানা গেল। যেমন একজন নারী সাংবাদিককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। রাজধানী ঢাকাতেই ঘটেছে ঘটনা। তিনি একটি সংবাদপত্রে কাজ করেন। রাতে বের হয়েছিলেন রাজধানীরই একটি এলাকায় অশ্লীল ভিডিও বানিয়ে ব্ল্যাকমেলিংয়ের কারবার চলছে এমন খবর পেয়ে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য। সেখানে গেলে ১৬ ব্যক্তি তাঁকে ঘেরাও করে, তারা তাঁকে একটি নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে যায় এবং দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে। আরেকটি খবর, ধর্ষণের অভিযোগে আটক কিশোরকে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে মারধর। (অর্থাৎ পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা নেই। অন্য একটি খবর, রাতের বেলা আটকে নারীকে ‘দলবদ্ধ’ ধর্ষণ, দুজন গ্রেপ্তার; রাজধানীর পল্লবীতে। আরও কয়েকটি খবর এ রকমের : ঝিনাইদহে ছুরি ধরে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ। নারায়ণগঞ্জে সাত বছরের শিশুধর্ষণ, ৫ হাজার টাকায় মীমাংসার চেষ্টা। পাঁচ জেলায় শিশুধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় ধর্ষণের ভয় দেখিয়ে এক বিধবার ঘরে ডাকাতির অভিযোগ। নীলফামারীতে সাত বছরের শিশুধর্ষণ, তিনজন গ্রেপ্তার। অতিশয় মর্মান্তিক খবরও আছে। যেমন হবিগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের খবর শুনে প্রাণ হারিয়েছেন শিশুটির পিতা। কেবল কিশোর এবং যুবকরাই নয়, ৭০ বছরের বৃদ্ধও ওই অপকর্ম করেছে। একটি নয়, দুটি শিশুকে ধর্ষণের দায়ে সে অভিযুক্ত। এবং ঘটনাটি ঘটেছে সংস্কৃতিচর্চার জন্য এককালে বিখ্যাত ঢাকার বিক্রমপুর এলাকায়।
ফেসবুকে পরিচয় কেমন বিপজ্জনক হতে পারে তার নমুনা তো অহরহই পাওয়া যায়। একটি ঘটনা এরকমের। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীটি বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত, রাজধানীতেই। জানুয়ারির ১৬ তারিখে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। বাসায় বলে গিয়েছিল কেনাকাটা করতে যাচ্ছে। ১৪ দিন পরে পুলিশ রবিন নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে মেয়েটির লাশ উদ্ধার করা হয়, হাতিরঝিল থেকে। মাঝখানের ঘটনা মেয়েটিকে ফোনে ডেকে নিয়ে ওই যুবক ও তার চার বন্ধু মিলে ধর্ষণ করে। অত্যাচারে মেয়েটির মৃত্যু ঘটলে তার লাশ বস্তায় পুরে মধ্যরাতে হাতিরঝিলে নিয়ে ফেলে দেয়। আরেক খবর, ফোনে পরিচয় নারায়ণগঞ্জের এক মেয়ের সঙ্গে এক যুবকের। যুবকটি তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় মালয়েশিয়ার ভিসা পাইয়ে দেবে। সেজন্য মেয়েটি সরল বিশ্বাসে যুবকটিকে ১ লাখ টাকাও দেয়। কিন্তু ভিসা সে পায়নি। পাচ্ছে না দেখে সে তাগাদা দেয়। যুবকটি তাকে ঢাকার একটি হোটেলে এসে টাকা নিয়ে যেতে বলে। শেওড়াপাড়ার এক হোটেলে মেয়েটি আসে। পরের ঘটনা তাকে সেখানে আটক করে আট-দশজন মিলে ধর্ষণ করার।
খবরের তো শেষ নেই। নোয়াখালীতে মাদরাসার প্রথম শ্রেণির ছাত্রীর লাশ পাওয়া গেছে কচুরিপানার নিচে। ধর্ষণের পর হত্যা করে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ওদিকে মাদরাসার প্রথম শ্রেণির নয়, শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীর লাশ পাওয়া গেছে, সেপটিক ট্যাংকে, রংপুরে।
পুলিশের কমিশনার বলেছেন, ‘ধর্ষণ’ শব্দটি তিনি পছন্দ করেন না। ধর্ষণের বদলে গণমাধ্যমকে নারী নির্যাতনের মতো ভদ্রচিত শব্দ ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। ধর্ষণ শব্দটি অবশ্যই বিশ্রী, কিন্তু বাস্তবতা যে শব্দের চেয়েও ভয়ংকর সেটা তিনি অস্বীকার করবেন কী করে? করতে পারেননি। বরং ধর্ষণ শব্দটি ব্যবহার করায় আপত্তি জানানোর জন্য পাবলিকের কাছে তাঁকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। সত্য এটাই, ধর্ষণের ভয়ংকরতাকে ভদ্র কোনো শব্দ দিয়ে আড়াল করা যাবে না; তার নিষ্ঠুরতা ও পরিমাণ বৃদ্ধিকেও ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রেখে কমানো সম্ভব নয়। কেবল ধর্ষণ নয়, বলাৎকারও চলছে। মাদরাসার শিক্ষক ধরা পড়ছেন বলাৎকারের অভিযোগে। মাদরাসার ব্যবস্থাপকও ওই কাজ করছেন।
এসবের কারণ কী? বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে প্রথম কারণ পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় পুরুষমাত্রেই ভাবতে প্ররোচিত হয়, সে কর্তা; জন্মগতভাবেই নারী, কন্যা-শিশু, এমনকি পুরুষ-শিশুর ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকার তার রয়েছে। সেই কর্তৃত্বের স্থূলতম প্রকাশ ধর্ষণ। কিন্তু কেবল কর্তৃত্ব তো নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভোগলিপ্সাকেও সযত্নে লালনপালন করে। ভোগেই সর্বসুখ, ভোগেই জীবন- এই বোধকে সজীব রাখার ব্যাপারে পুঁজিবাদ সক্রিয় থাকে। দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাদীব্যবস্থা স্বৈরাচারী ও হিংস্র এবং সেসব যে কেমন হতে পারে তার প্রমাণ তো প্রতিনিয়তই পাওয়া যায়, খুব পরিষ্কারভাবেই পাওয়া যায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্তৃপক্ষের আচার-আচরণে। ওই স্বৈরাচার ও হিংস্রতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনুকরণীয় ও প্রতিপালনীয় আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণ ওই কাজেরই একটি বটে।
দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণকারীরা বেশ বেপরোয়া এবং প্রায়শ কাজটি তারা করে দলবদ্ধভাবে। বেপরোয়া হওয়ার প্রধান কারণ এই ধারণা, অপরাধ করলেও ধরা পড়বে না, ধরা পড়লেও ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। ধর্ষকদের ভিতর এই বোধও কাজ করে, তাদের হারাবার কিছুই নেই, কিন্তু পাওয়ার আছে সর্বসুখ।
ধর্ষণ যেহেতু একটি ক্ষমতা-সম্পর্ক, প্রবলের বলপ্রয়োগ দুর্বলের ওপর, তাই দলবদ্ধ হলে ক্ষমতা এবং সেই ক্ষমতা প্রয়োগের সাহস দুটোরই বৃদ্ধি ঘটে। (‘দশে মিলে করি কাজে’র বর্বরতম সংস্করণ বটে!) এটাও খেয়াল করার ব্যাপার, দেশে সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা এখন লুপ্ত হওয়ার দশায়। সংস্কৃতির চর্চা যৎসামান্য। নাটক, গানবাজনা নেই, খেলার মাঠ উধাও, সিনেমা হলগুলো বন্ধ, পাঠাগার অনাকর্ষণীয়। উল্টো দিকে চলছে মাদক ও পর্নোগ্রাফির ব্যবসা। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে না; ফলে বেকারত্ব এবং অপরাধ দুটোই বাড়ছে।
দেশে কিশোর আন্দোলন নেই; আছে কিশোর গ্যাং। বিপথগামী কিশোররা দলবদ্ধ হয়, ছিনতাই, খুনখারাবি, ধর্ষণ ইত্যাদি করে। তাদের অবরুদ্ধ বীরত্ব অপরাধের অন্ধকার গলি-ঘুপচি দিয়ে প্রকাশের পথ খুঁজে বেড়ায়। একাত্তরে এই কিশোররাই মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাদের কাছে সশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত এবং ভয়াবহ রকমের হিংস্র পাকিস্তানি হানাদারেরা হার মেনেছে। এখন যুদ্ধ নেই, তারা তাই প্ররোচিত হচ্ছে অপরাধে। এটাকেও তারা যুদ্ধই মনে করে, তবে কার বিরুদ্ধে লড়ছে সেটা খেয়াল করার মতো বোধ তাদের নেই। শত্রুকে চিহ্নিত করতে পারলে তারুণ্য যে কেমন দুর্বার হতে পারে, তার প্রমাণ তো দেশের প্রতিটি অভ্যুত্থানেই পাওয়া গেছে। অভ্যুত্থানে নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ ছিল না; কিন্তু তার বাইরে সেটা ঠিকই ছিল। এবং অভ্যুত্থান শেষে সেই ব্যবধান সবেগে উত্থিত হয়েছে।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনি, বিচারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ধরনের প্রতিরোধই গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না, অপরাধের উৎস হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানায় স্থির বিশ্বাসী পুঁজিবাদী উন্নয়ন; তাকে বিদায় না করতে পারলে পীড়ন থেকে আমাদের মুক্তি নেই; সংস্কার ও প্রতিরোধকে তাই নিয়ে যেতে হবে সামাজিক বিপ্লবের অভিমুখে। সমাজবিপ্লব ঘটেনি বলেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল যে অসমাপ্তই রয়ে গেছে তা নয়, তার অর্জনগুলোর অধিকাংশই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে; এবং সে জায়গায় আগের চেয়েও জঘন্য সব অপরাধ ঘটছে, উৎপীড়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমাজ বিশ্লেষকরা লক্ষ করেছেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাদী উন্নয়ন ধারার অভ্যন্তরে গ্রামাঞ্চলে নীরবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে গেছে।
সেটি হলো, ঘরের তো অবশ্যই, ঘরের বাইরেও মেয়েদের ক্ষমতাবৃদ্ধি। ধর্ষণ যেমন সত্য, এই ক্ষমতায়নও তেমনি সত্য। মাগুরার ধর্ষিতা মেয়েটির মা যেভাবে সংসারের হাল ধরেছেন, সেভাবে বিপুল, কোথাও কোথাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েরাই সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যে পুরুষ আয়-রোজগার করেন, তিনি ঘরের বাইরে থাকেন; শহরে যান, চলে যান বিদেশে; কিন্তু কর্তৃত্ব তাদেরই। ব্যবস্থাটা নির্ভুলভাবেই পিতৃতান্ত্রিক। কিন্তু সংসার চালাতে হয় মেয়েদেরই। সন্তান পালন, পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা, বিবাহ, খাওয়াদাওয়া, অসুখবিসুখে চিকিৎসা, খরচপাতি সব মেয়েদের ব্যবস্থাপনাতেই চলে। শহরেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংসারের দায়িত্বগুলো মায়েরাই পালন করেন।
মেয়েরা বেরিয়ে এসেছেন। তারা শহরের কারখানায় কাজ করেন, কাজের খোঁজে মধ্যপ্রাচ্যে পর্যন্ত চলে যান। এবং নিগৃহীত হন; দেশে ও বিদেশে। তবে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে যেটা দেখা গেল, তা হলো মেয়েদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ। আমাদের সব আন্দোলনেই মেয়েরা থেকেছেন, কিন্তু এবার যে সংখ্যায় ও দৃঢ়তার সঙ্গে অংশ নিয়েছেন তেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। অনেক জায়গাতে মেয়েরাই ছিলেন সামনের কাতারে এবং তাদের সামনে থাকাটা ছেলেদের সাহস, এমনকি আপেক্ষিক নিরাপত্তাও বৃদ্ধি করেছে। মাগুরার মেয়েটির ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ দেখা গেছে, তাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের চেয়েও শক্তিশালী। তারা বিক্ষোভ করেছেন এবং ঢাকায় পুলিশ সদস্যদের দ্বারা প্রহৃত পর্যন্ত হয়েছেন। মেয়েদের এই জাগরণ আশা জাগায়। তবে তাদের, যেমন ছেলেদেরও আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। সংস্কারে কুলাবে না। প্রয়োজন হবে সামাজিক বিপ্লবের। সংস্কার আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হবে, কিন্তু তাতে মূল যে সমস্যা, পুঁজিবাদী উন্নয়ন-সে সমস্যার সমাধান হবে না। পুঁজিবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা বদলাবে না। সংস্কার বরং তাকে রক্ষা করতেই চাইবে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়