‘মুঝে দিল সে না ভুলা না, চাহে রুখে এ জামানা, তেরে বিন মেরা জীবন কুছ নেহি... কুছ নেহি...’ এ গানটি শোনলে এখনো দৃষ্টিসীমানায় ভেসে ওঠে দুই মায়াবি মুখের চিত্র, নাদিম-শবনম। এটি তাঁদের সবচেয়ে দর্শকপ্রিয় ছবি ‘আয়না’র গান। ষাটের দশক থেকে জুটি বেঁধে কমপক্ষে ৩৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তাঁরা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁদের যাত্রা শুরু হলেও একসময় তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানকার চলচ্চিত্রে থিতু হন। নব্বই দশকের শেষদিকে শবনম বাংলাদেশে ফিরে এলেও নাদিম আসেননি। তিনি সেখানকার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি ২০০৫ সাল থেকে টিভিনাটকেও অভিনয় শুরু করেন। নাদিমের দুই পুত্র ফারহান ও ফয়সল। ১৯৬৮ সালে নাদিম বিয়ে করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের কন্যা ফারজানাকে। অন্যদিকে শবনম বিয়ে করেন খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষকে। রবিন ঘোষ কয়েক বছর আগে মারা যান। শবনম এখন ঢাকার বারিধারায় একমাত্র পুত্র রনিকে নিয়ে বসবাস করছেন। আর নাদিম পশ্চিম পাকিস্তানে পরিবার নিয়ে ভালো আছেন। নাদিম এখনো অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও শবনম সর্বশেষ অভিনয় করেন ১৯৯৯ সালে কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’ ছবিতে। শবনম-নাদিম জুটির ছবি দেখতে একসময় দর্শক তীর্থের কাকের মতো মুখিয়ে থাকত। এ উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতে যত দর্শক পছন্দের জুটি রয়েছে তার মধ্যে নাদিম-শবনম জুটি অন্যতম। নাদিমের প্রকৃত নাম- মির্জা নাজির বেগ। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র অভিনেতা, গায়ক ও প্রযোজক। ১৯৬৭ সালে কর্মজীবনের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৯৭-এর প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার জিতেছেন তিনি। পাকিস্তানে নাদিম ভারতের অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের মতো মর্যাদা পেয়ে থাকেন। নাদিম ১৯৪১ সালের ১৯ জুলাই ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। নাদিমের পরিবার ভারত বিভাজনের পর ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। বাংলাদেশের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান নাদিমের গান গাওয়ার প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়ে ঢাকা চলচ্চিত্রশিল্পে তাঁকে প্লেব্যাক করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। নাদিম প্রথম অভিনয় করেন ১৯৬৭ সালে ‘চকোরী’ চলচ্চিত্রে শাবানার সঙ্গে জুটি বেঁধে। এটি নির্মাণ করেন এহতেশাম। চকোরীতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে নাদিমকে নিগার পুরস্কার দেওয়া হয়। নাদিম প্রায় ১৬ বার পাকিস্তানের মর্যাদাসম্পন্ন নিগার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ১৯৯৭ সালে হাসিন কারকারদেগি পুরস্কারেও ভূষিত হন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি নাদিম বেশ কিছু চলচ্চিত্রের জন্য গান গেয়েছেন এবং ছবি প্রযোজনা করেছেন। নাদিম অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- চকোরী, আয়না, দিয়া অউর তুফান, দামান অউর চিংগারি, বানদিস, দিল্লাগি, শামা, ফুল ম্যাঁ গুলশান কা, আনাড়ি, জাব জাব ফুল খিলে, পেহচান, উমাং, নাদান, ছোটে সাহাব, আম্বার, আকিজা, দূরদেশ প্রভৃতি।
অন্যদিকে চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘আম্মাজান’ সিনেমায় সর্বশেষ নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেন। শবনমকে বাংলাদেশের দর্শক ‘হারানো দিন’, ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘নাচের পুতুল’-এর নায়িকা হিসেবেই বেশি চিনতেন। এরপর তিনি বাংলাদেশের ‘সন্ধি’, ‘শর্ত’, ‘সহধর্মিণী’, ‘যোগাযোগ’, ‘জুলি’,‘ বশিরা’, ‘দিল’ ‘নিয়ত’ সহ আরও অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। দীর্ঘদিন তিনি পাকিস্তানের সিনেমাতে অভিনয় করেছেন বলে অনেকেই মনে করতেন তিনি পাকিস্তানের নায়িকা। এ ধারণা ভুল। শবনমের আসল নাম ঝরনা বসাক। তিনি পুরান ঢাকার লালমোহন শাহ স্ট্রিটের মেয়ে। শবনম বলেন, দেখতে দেখতে ৭৮টি বছর পার করে দিলাম। অথচ এখনো মনে হয় এই তো সেদিনের কথা, বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটছে, স্কুলে যাচ্ছি, ফিল্ম করছি। আর এখন ভাবলে মনে হয় কত সময় চলে গেছে জীবন থেকে। তিনি বলেন, এখনো সুস্থ আছি, ভালো আছি-এটাই কম কীসের। বয়স তো আর কম হলো না। সবার দোয়া ও ভালোবাসা চাই। চলচ্চিত্রে আসার অনেক আগে থেকেই শবনম নাচের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শিখতেন। এহতেশাম পরিচালিত ‘এদেশ তোমার আমার’ সিনেমাতে তখন একটি গানে বেশ কয়েকজন নাচের মেয়ের দরকার হয়। তখন বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকেই কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই দলে শবনমও ছিলেন। এরপর ‘রাজধানীর বুকে’ সিনেমাতে তিনি একটি একক নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে অভিনয়ে যুক্ত হন এবং ১৯৬১ সালে এহতেশাম তাঁকে আর রহমানকে জুটিবদ্ধ করে নির্মাণ করেন ‘হারানো দিন’ সিনেমাটি। এরপরের বছর এহতেশামের উর্দু সিনেমা ‘চান্দা’য় অভিনয় করে পাকিস্তানে তারকাখ্যাতি পান তিনি। প্রায় সাড়ে তিন শ সিনেমায় অভিনয় করেন শবনম। শবনমের জন্ম ১৭ আগস্ট ১৯৪৬ সালে। এ অভিনেত্রী অভিনয় করেছেন পাঞ্জাবি চলচ্চিত্রেও। পাকিস্তানের সিনেমায় তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে মহানায়িকা বলা হয়। নিজ অভিনয়গুণে দেশটির চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার নিগার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি তেরবার। বিশ্বে তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী যিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৮০র দশক পর্যন্ত তিন দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে একটি ইন্ডাস্ট্রিতে নায়িকা হিসেবে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিলেন। সেই সুবাদে নাদিম-শবনম জুটিকে এ উপমহাদেশের দর্শক হয়তো কোনোদিনই ভুলবে না।