দেশীয় চলচ্চিত্রের 'উন্নয়ন' ফাঁকা বুলিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। নানা প্রতিকূলতায় চলচ্চিত্র এখন ধংসপ্রায়। এসবের মধ্যে অশ্লীলতা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রকারার বলছেন সরকার যথার্থ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কঠোর আইন নেই। যা আছে তারও প্রয়োগ নেই। অশ্লীলতা নির্মূলে র্যাবের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের কার্যক্রমও শিথিল। স্থানীয় প্রশাসনও রহস্যজনক কারণে নিশ্চুপ। দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃৃহে অবাধে প্রদর্শন হচ্ছে অশ্লীল দৃশ্যসংবলিত ছবি, পোস্টার ও ফটোসেট।
বৃহস্পতিবার সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয় অশ্লীলতার অভিযোগে চারটি ছবির সেন্সর সনদ সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। এগুলো হলো- 'পাগল তোর জন্যরে', 'কিছু আশা কিছু ভালোবাসা', 'খুনী বিল্লাহ' এবং 'নগদ'। চলচ্চিত্রকাররা বলেন, নির্মাতারা এখন এতটাই বেপরোয়া যে প্রথম দুটি ছবিতে সেন্সরবোর্ড কর্তৃক কর্তনকৃত অশ্লীল দৃশ্য আবার জুড়ে দিয়ে তা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য জমা দিয়েছে।
গত বছর থেকে চলচ্চিত্রে আবার অশ্লীলতার আগ্রাসন দেখা দিয়েছে। ২০১৪ সালের প্রথম ছবি অর্থাৎ ১৭ জানুয়ারি মুক্তিপ্রাপ্ত 'দাবাং' ছবিটি অশ্লীল দৃশ্য, পোস্টার এবং ফটোসেটের জন্য সমালোচনার মুখে পড়ে। মে মাসে ময়মনসিংহের সেনা অডিটোরিয়ামে বিতর্কিত পোস্টার টাঙিয়ে প্রদর্শন করা হয় অশ্লীল ছবি 'খুনের পরিণাম'। জুন মাসে মুক্তি পায় বিতর্কিত শিল্পী পলি, ঝুমকা, সোহেল অভিনীত স্বপন চৌধুরী পরিচালিত অশ্লীল দৃশ্য ও পোস্টারসংবলিত ছবি 'চোরের রাণী'। ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়া এই অশ্লীল ছবিটি তখন র্যাবের তৎপরতার কারণে মুক্তি লাভে ব্যর্থ হয়। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া 'রাজত্ব' ছবিটির বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে। ঈদে মুক্তি পাওয়া 'আই ডোন্ট কেয়ার' ছবিটি অশ্লীল পোস্টার ও দৃশ্যের কারণে সমালোচিত হয়। ২২ আগস্ট মুক্তি পায় মোস্তাফিজুর রহমান বাবু নির্মিত 'কখনও ভুলে যেওনা'। এর গানে ছিল রগরগে দৃশ্যে ভরা। নায়ক-নায়িকা বৃষ্টিতে খোলামেলা ও উদোম হয়ে নাচে। নভেম্বরে লালমনিরহাটের উত্তরা সিনেমা হলে 'মরণ আঘাত'। ডিসেম্বরে চুয়াডাঙ্গার পান্নায় 'নিরাপত্তা'। সিরাজগঞ্জের মৌসুমীতে একটি ইংরেজি ছবি। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার মানসীতে 'রঙিন চশমা', শিউলীতে 'নিখোঁজ সংবাদ'। ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুরের ঝুমুর ও নন্দিতায় 'ল্যাংরা মাসুদ'। চলতি মাসে ঠাকুরগাঁওয়ের পাভেল ও পূর্ণিমায় 'নষ্ট মেয়ে' এবং ফেনীর কানন সিনেমায় 'জাদরেল' প্রদর্শিত হয়। অশ্লীলতার অভিযোগে প্রশাসন এসব ছবি এবং প্রেক্ষাগৃহের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করে। এদিকে সম্প্রতি অশ্লীল দৃশ্য ও সংলাপের অভিযোগে 'নগর মাস্তান' শিরোনামের একটি ছবিকে ছাড়পত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায় সেন্সর বোর্ড। তা ছাড়া সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া 'দেশা দ্য লিডার', 'স্বপ্নছোঁয়া', 'ক্ষণিকের ভালোবাসা' ছবিগুলোর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনে এসব ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে শোকজ নোটিস দেয় প্রশাসন। ২৫ ফেব্রুয়ারি কাকরাইলের প্রোডাকশন হাউসে অভিযান চালিয়ে র্যাব বিপুল পরিমাণে অশ্লীল ছবি, কার্টপিস, পোস্টার ও ফটোসেট উদ্ধার এবং দুজনকে আটক করে।
চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন, সুচন্দা, ববিতা, মিয়া আলাউদ্দীন, আজিজুর রহমান, ছটকু আহমেদ প্রমুখরা প্রায় অভিন্ন অভিযোগে বলেন, অশ্লীলতা রোধে ১৯৬৩ সালের সেন্সরশিপ আইনটি বর্তমান সময় উপযোগী নয়। তাছাড়া অশ্লীলতাবিরোধী টাস্কফোর্সের কার্যক্রমও শিথিল। তারা বলেন, সম্প্রতি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড সেন্সরবিহীন অশ্লীল দৃশ্য সংযোজনের অভিযোগের পর এক বা একাধিক ছবিকে নিষিদ্ধ করেছে। তবে উক্ত বোর্ডে জনবল কম থাকায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনিয়মের কারণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না অশ্লীল ছবির বিরুদ্ধে। চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা রোধে গঠন করা হয়েছিল একটি টাস্কফোর্স। প্রথম অবস্থায় টাস্কফোর্সের সদস্যরা ভালোই সফলতা দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক পরিচয়ে অনেকেই ফের শুরু করেন অশ্লীল ছবির প্রদর্শন। জানা গেছে, একশ্রেণীর চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশকদের অফিস থেকে দেদারসে সেন্সরবিহীন অশ্লীল কাটপিস সরবরাহ করা হয়। এসবের সঙ্গে জড়িত রয়েছে কতিপয় সিনেমা হল মালিক। কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের নতুন আইনটিও দমাতে পারছে না তাদের। এফডিসির অভ্যন্তরেও অশ্লুীল ছবি শুটিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। অথচ সংশ্লিুষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন এসব জেনেও না জানার ভান করে। অশ্লীলতা বন্ধে এফডিসির একটি মনিটরিং ইউনিট আছে। এই ইউনিটের লোকদের দায়িত্ব এফডিসিতে কি কি হচ্ছে তার খবর রাখা। এক্ষেত্রে মনিটরিং ইউনিটেরও কোনো ভূমিকা পালন হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
ঢাকার বাইরে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার আগ্রাসন আরও বেশি। এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় প্রভাব। অনেক সময় অশ্লীল ছবির নির্মাতারা কৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ছবিগুলো প্রদর্শনের জন্য রায় বা অনুমতি নেয় আদালত থেকে। এ নিয়ে আদালতের স্বচ্ছতারও প্রশ্ন উঠেছে। আদালত রায় দিলে প্রশাসন এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে না। এ জন্য আগে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি। পাশাপাশি দর্শকদের রুচিরও পরিবর্তন হওয়া দরকার।
এদিকে চলচ্চিত্রে পাইরেসি ও অশ্লীলতারোধে গঠিত টাস্কফোর্সের কো-অর্ডিনেটর মেজর রাজিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টাস্কফোর্সের কর্মকাণ্ড শিথিল হয়ে পড়ার অভিযোগ মানতে আমি নারাজ। আমাদের কার্যক্রমের আভিধানিক প্রেক্ষাপট আগের মতোই আছে। প্রতিমাসে এ কাজের পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হচ্ছে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ভিকটিমদের সহযোগিতা তেমন পাই না। তারা যদি নিয়মিত তথ্য দিয়ে সহায়তা করত তাহলে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা বলে আর কিছুই থাকত না। তারা এক স্টেপ এগিয়ে এলে আমরা তিন স্টেপ এগিয়ে যাব। চলচ্চিত্র থেকে অশ্লীলতা নির্মূলে আমাদের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।