২৫ নভেম্বর, ২০২০ ১৩:১১
নির্মাতার প্রশ্ন?

চলচ্চিত্রটা নির্মাণ করব কোথায়?

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রটা নির্মাণ করব কোথায়?

চলচ্চিত্রের দুঃসময় জেনেও প্রধান এই গণমাধ্যমটি বাঁচানোর জন্য বিবেকের তাড়নায় এফডিসিতে ছুটে এলেন হেমায়েত সাহেব। তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন নিজের গচ্ছিত কিছু অর্থ দিয়ে একটি ছবি বানাবেন। এফডিসিতে পা রাখতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তার ধারণা ছিল ছবি নির্মাণ আর তারকাদের পদচারণায় বুঝি চলচ্চিত্র নির্মাণের এই প্রধান সূতিকাগারটি মুখর থাকবে। কিন্তু না, চলছে মিটিং, গগনবিদারী মিছিল, লোকজনের মাঝে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। কান পেতে শুনলেন, না এগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো অংশ নয়। তাহলে কী? একজন বললেন, ‘আরে ভাই নতুন এসেছেন এখানে, আপনার বুঝতে সময় লাগবে। এসেই যখন পড়েছেন আর যাবেন কোথায়? সিনেমা বানানোর শখটা পূরণ করে যান। নবাগত নির্মাতা এমন কথায় কিছুটা শঙ্কিত আর তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। আবার জানতে চাইলেন শুটিং না হলে এসব মিটিং মিছিল কিসের? জবাবদাতার মন্তব্য ছিল এমন, ‘আরে ভাই এখন এফডিসিতে শুটিং হয় নাকি। কবেই এটি বিরানভূমি হয়ে যেত। এটিকে তো টিকিয়ে রেখেছে সমিতি নামক কিছু সংগঠন। ওরাই তো মিছিল, মিটিং, ইফতার পার্টি, পিকনিকসহ ব্যক্তিগত অনেক উৎসব করে এফডিসিকে সরব রেখেছে। মাঝে-মধ্যে দেখবেন একদল মানুষ একের পেছনে অন্যরা ছুটছেন। এটিকেও শুটিং ভেবে ভুল করবেন না। বিভিন্ন সমিতির মধ্যে ঝগড়া ফ্যাসাদের কারণে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দাবড়ানি দিচ্ছে। এসব কথা শুনে বেচারা হেমায়েত সাহেব কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। অগত্যা প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে ছবি নির্মাণের যাবতীয় ব্যয় মিটিয়ে পা বাড়াতেই একজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন ছবি তো বানাবেন ভাই, প্রযোজক সমিতির পার্টি হয়েছেন। হেমায়েত আবারও বিব্রত। প্রযোজক সমিতির পার্টি মানে। লোকটি বলল, হ্যাঁ ভাই, এখানে ছবি বানাতে গেলে শুধু এফডিসির পাওনা পরিশোধ করলে চলবে না। নানা সমিতিতে হাজার লাখ টাকা দিয়ে পার্টি হয়ে তারপরই পাবেন ছবি নির্মাণের সার্টিফিকেট। হেমায়েত সাহেব এখন ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। নিজেকে প্রশ্ন করলেন-এ আমি  কোথায় এলাম? কেন এলাম? চারদিকে তখনো মিছিল-মিটিং আর ছোটাছুটি চলছে, ছবি নির্মাণের ছায়াও নেই। প্রশাসনিক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখছেন অমুক-তমুক সমিতির সাইনবোর্ড। এতে হতাশ নবাগত নির্মাতা নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ‘ছবিটা বানাব কোথায়?’

এই তো গেল চলচ্চিত্র নির্মাণের একজন নতুন স্বপ্নদ্রষ্টা হেমায়েত সাহেবের স্বপ্নভঙ্গের চরম কষ্টের গল্প। এমন হেমায়েত সাহেব প্রায় প্রতিদিনই এফডিসিতে আসেন আর স্বপ্নের অপূর্ণতা নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

এফডিসি প্রশাসনের কাছে জানতে চাইলাম, এখানে এত সমিতি কেন? নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানালেন তারা তো স্টাডিরুম হিসেবে অনেক আগেই বিভিন্ন অফিস ভাড়া নিয়ে বসে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস প্রশাসনের নেই। তারা নানাভাবে শক্তিশালী। কারণ তারা নেতা। ওই কর্মকর্তা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, অর্থের অভাবে এফডিসি কর্তৃপক্ষ আমাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা ও অবসরপ্রাপ্তদের গ্র্যাচুইটি দিতে পারছে না। অথচ সমিতির অফিস ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি ও রক্ষণাবেক্ষণ বিল বাবদ এখন পর্যন্ত এফডিসি সমিতিগুলোর কাছে পাওনা আছে ৮০ লাখ ৩ হাজার ৬২৩ টাকা। এর মধ্যে প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির কাছে ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩০ টাকা, পরিচালক সমিতির কাছে ২৪ লাখ ৯২ হাজার ৪৫৯ টাকা। শিল্পী সমিতির কাছে ১৫ লাখ ৯২ হাজার ৯৬৮ টাকা। চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থার কাছে ৮ লাখ ৯ হাজার ৭০৭ টাকা। সিডাবের কাছে পাওনা ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৯ টাকা। ফিল্ম এডিটরস গিল্ডের কাছে পাওনা ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫৬ টাকা। চলচ্চিত্র ব্যবস্থাপক সমিতির কাছে পাওনা ২ লাখ ৬৮ হাজার ৭৫৪ টাকা।
একজন নির্মাতা দুঃখভরে জানালেন, এফডিসি চলচ্চিত্র নির্মাণের সূতিকাগার হলেও এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্ণাঙ্গ টেকনিক্যাল সাপোর্ট নেই। যা কিছু যন্ত্রপাতি রয়েছে তা চালানোর মতো টেকনিশিয়ানও নেই। চলচ্চিত্র নির্মাণের মূল অনুষঙ্গ ‘পোস্ট প্রোডাকশন’-এর কাজই এখানে হয় না। এর জন্য দেশের বাইরে গিয়ে অপচয় হয় বিপুল দেশীয় অর্থ। এতে একদিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে, অন্যদিকে বড় অঙ্কের অর্থ ও সময় ব্যয়  হচ্ছে নির্মাতার। এক কথায় নির্মাতাকে হতে হচ্ছে নাকাল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফডিসির ওই কর্মকর্তা বলেন, যন্ত্রপাতি, টেকনিক্যাল সাপোর্ট সবই আছে, নেই টেকনিশিয়ান।  ২০০৪ সালে এফডিসি সর্বশেষ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেয়। তখন চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো এনালগ পদ্ধতিতে। সেই টেকনিশিয়ানরা ২০১২ সালের পর চালু হওয়া ডিজিটাল পদ্ধতির মেশিন পরিচালনা করবেন কীভাবে? এ জন্য টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিংয়ের জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে। না হলে চারুকলা বিভাগ থেকে পাস করা টেকনিশিয়ানদের নিয়োগ দিতে হবে।

এক্ষেত্রে রয়েছে আরও জটিলতা। একদিকে কোনো সিনেমা হলেই ন্যূনতম টু কে রেজুলেশনের প্রজেক্টর নেই। যার কারণে নির্মাতারা কালার গ্রেডিং না করেই ছবি মুক্তি দেন। ফলে কালার গ্রেডিং মানে পোস্ট প্রোডাকশনের একটি অংশই রয়ে যায় অব্যবহৃত। এর জন্য বড় অঙ্কের বেতন দিয়ে লোক নিয়োগ বা বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে লাভ কী হবে। এফডিসি তো আরও ক্ষতির মুখে পড়বে।

এদিকে নানা ঝক্কি-ঝামেলা সামলে ছবি নির্মাণ করেই নির্মাতার কষ্ট লাঘব হয় না। ছবি মুক্তি দিতে গিয়ে আবার পড়েন মহাবিপদে। এবার বড় অঙ্কের অর্থ গুণতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। একজন নির্মাতা সরাসরি সিনেমা হল মালিকদের কাছে গিয়ে ছবি মুক্তি দিতে পারেন না। তাকে দ্বারস্থ হতে হয় বুকিং এজেন্টদের। যা পৃথিবীর কোথাও নেই।

এ বিষয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ কুমার দাস বলেন, তৎকালীন পাকিস্তান আমলে একজন প্রযোজকের ছবি পরিবেশকরা ৫ পার্সেন্ট কমিশনের বিনিময়ে নিয়ে সিনেমা হলে মুক্তি দিতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রযোজক ও পরিবেশক মিলে ‘চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতি’ গঠন করলে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে বুকিং এজেন্টের উদ্ভব হয়। তারা মোটা অঙ্কের কমিশন ছাড়া সিনেমা হলে ছবি মুক্তি দিতে দেয় না। ফলে নির্মাতা হন নাকাল। বলতে গেলে প্রদর্শক ও প্রযোজকদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে লাভের অর্থ খেয়ে যাচ্ছে বুকিং এজেন্ট নামের মধ্যস্বত্বভোগীরা।

এর জন্য দায়ী হলেন প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম। তিনি একসময় বুকিং এজেন্ট ছিলেন। প্রায় ৩৬টি সিনেমা হল তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন বুকিং এজেন্টদের কোনো সংগঠন ছিল না।

চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সাইফুল ইসলামই একসময় নিজে প্রধান উপদেষ্টা হয়ে সিরাজুল ইসলামকে সভাপতি করে গঠন করেন ‘বুকিং এজেন্ট’দের সংগঠন। তখন থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাতারা ছবি মুক্তি দিতে গিয়ে হচ্ছেন চরম নিষ্পেশিত আর প্রদর্শকরাও গুণছেন বড় অঙ্কের লোকসান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর