ইদানীং আমার কী হয়েছে বলতে পারব না। রাতে ঘন ঘন ঘুম ভেঙে যায়। তারপর হালকা একটু তন্দ্রা এবং দুর্বোধ্য সব স্বপ্ন। বেশির ভাগ স্বপ্নই শিশুতোষ এবং ফোক ফ্যান্টাসি প্রকৃতির। শিশুবেলার মতো স্বপ্ন দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠি। স্ত্রী মহোদয়া ভীষণ বিরক্ত হন। জিজ্ঞাসা করেন কী দেখলে। যখন বলি কিছুই মনে করতে পারছি না, তখন তার বিরক্তি চরমে পৌঁছে। এমনিতেই তিনি সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন। বুয়া কেন এলো না, বাজারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ে- কিন্তু আমি তো সংসার খরচ বাড়াই না। বয়স ষাটের কাছাকাছি পৌঁছায় কিছু শারীরিক জটিলতাও দেখা দিয়েছে। কিন্তু দায়িত্ববান স্বামী হিসেবে আমি ওসবের ধার না ধেরে রাত-বিরাত খিলখিলিয়ে হাসি। ফলে আমাকে নিয়ে তার আতঙ্ক বেড়ে যায়।
ঢাকার অদূরে সাভারে জঙ্গলঘেরা আমাদের একটি বাংলোবাড়ি আছে। সেখানে বড় বড় কয়েকটি লেক- তারপর বাঁশঝাড় এবং অন্যান্য বৃক্ষরাজির মধ্যে জিন-ভূতেরা বাস করে বলে আমাদের কেয়ারটেকার আমার স্ত্রী-সন্তানদের সতর্ক করেছে। রাতের বেলায় একাকী সেই বাঁশঝাড়ের কাছে যাওয়ার জন্য আমার বড় ছেলে জিদ ধরল। কিন্তু আমার ডাক্তার পুত্রবধূ কোনো অবস্থাতেই তাকে যেতে দিল না। আমার সাহসিনী মেয়েও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বর বারণ করায় সে হয়তো বেঁচে গেছে। আমি বহুবার সেখানে গিয়েছি রাত-বিরাতে। কখনো একাকী আবার কখনো সস্ত্রীক। এটা নিয়ে আমার বাড়ির কেয়ারটেকার ভীষণ বিরক্ত। আমাদের শিশুসুলভ আচরণ তার একেবারে অপছন্দ। তার দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে। একটির বয়স সাত, অপরটির এগারো। উভয়েই স্থানীয় একটি মাদরাসায় কোরআনে হিফজ শিখছে। ওরা আমাকে দাদুভাই ডাকে আর তাদের আব্বা ডাকে বাবা বলে। তো আমার নাতনিরা তাদের আব্বার পরামর্শে মাদরাসার হুজুরের সঙ্গে হয়তো তাবিজ নিয়ে কথাবার্তা বলেছে। হুজুর বুদ্ধি দিয়েছেন, চারটি তাবিজ বাড়ির চার কোনায় পুঁতে রাখতে হবে এবং আমাকে ঝাড়ফুঁক দিতে হবে।
আমার স্ত্রী উল্লিখিত ঘটনা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। জিন-ভূত নেই- ওসব কুসংস্কার ইত্যাদি বলে ওদের হাই কোর্ট দেখিয়ে দেন। কিন্তু ইদানীং গভীর রাতে আমার হাসাহাসি দেখে তার সন্দেহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। রাতের বেলায় তেমন কিছু না বললেও সকালে নাশতার টেবিলে যখন জিন-ভূতের গল্প বলে এবং ইন্টারনেটে ওসব নিয়ে কী সব ঘাঁটাঘাঁটি করে তাতে করে আমি বিলক্ষণ টের পাই যে- আমার কিছু একটা হয়েছে।
ইদানীং আমি সময় পেলে বড় ছেলের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলি। তাকে বিদেশ থেকে ফিরে আসতে বলি। আর বলি দ্রুত সন্তান-সন্ততি নেওয়ার জন্য। আমাদের কথায় বউমা যোগ দেয়- বলে বাবা দোয়া করেন আমাদের যেন টুইন বেবি হয়। আমি দোয়া করি এবং সেই কা- দেখে আমার স্ত্রী রাগে গজগজ শুরু করেন। আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর আগে। তার ঘরে সন্তান-সন্ততির জন্যও আমি উদগ্রীব হয়ে আছি। আমার খুব ইচ্ছা হয় নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খুনসুটি করতে।
তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওয়া ওয়া চুয়া চুয়া করতে। আমার ইচ্ছা জাগে ওদের সঙ্গে চকলেট ললিপপ-আইসক্রিম ও খেলনা নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করতে এবং জীবনের সব বেদনা-হতাশা সাগরে নিক্ষেপ করে ওদের হাত ধরে নতুন এক কল্পনার জগতের অভিযাত্রী হয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করতে।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে আমার যে হালহকিকত তা কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তখন ছিল না। আমার পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল সেই ১৯৮৬ সালে। পেশাগত কারণে তখন থেকেই দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী-আমলা-কামলা, কবি-সাহিত্যিক সুধীজনসহ আলেম-ওলামাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খানাপিনা-কথাবার্তা ও ভাব বিনিময়ের সুযোগ হয়েছে। গত ৪০টি বছর শীত নেই- গ্রীষ্ম নেই- দিন নেই, রাত নেই শুধু কাজ আর কাজ করে এসেছি। জীবনযুদ্ধের সফলতা-ব্যর্থতা, জয়-পরাজয় কিংবা পিছু হটা কোনো কিছুই জীবনের গতিকে জিন-ভূত-ললিপপ অথবা তাবিজ-কবজের দরবারে নিতে পারেনি। আমার জীবনের বাস্তবতা এবং ব্যস্ততা এত বেশি ছিল যে- স্বপ্ন দেখার সময় হয়নি। কর্মের চূড়ান্ত সফলতা, জীবনের অভিজ্ঞতা এবং পদে পদে বাস্তব শিক্ষা লাভের সুযোগের কারণে অজানা ভয়-আতঙ্ক-সন্দেহ-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সিদ্ধান্তহীনতা আমার ডিকশনারিতে ছিল না।
আমি সারাজীবন ঝুঁকি নিয়েছি। বিরূপ পরিস্থিতি সাহস দিয়ে মোকাবিলা করেছি। অসাধ্য বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করেছি। ফলে ১৯৮৬ থেকে ২০২৪ সাল অবধি কত রাজা গেছেন এবং কত রাজা এলেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনার সময়ই হয়নি। বরং নিজের দৈনন্দিন কাজের চাপ-দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং চলার পথের স্বাভাবিক বিপদ-বিপত্তি, প্রতিযোগিতা-চক্রান্ত ইত্যাদি মোকাবিলা করতে গিয়ে শরীর ও মনে এক নতুন প্রাণশক্তি এবং উদ্ভাবনী শক্তির সঞ্চার হতো। শত শত রাজনৈতিক বিরোধী, অর্থনৈতিক সমস্যা, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যাগুলো জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মনে হতো এবং সেগুলো সমাধানের জন্য একটার পর একটা উপায়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাজির হতো। আর এভাবেই ২০২৪ সালের জুলাই মাস আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় নিয়ে হাজির হয়।
গত এক বছরে আমার স্মরণশক্তির মহাসর্বনাশ হয়েছে। চারদিক থেকে শুধু একের পর এক বিপর্যয়ের সংবাদ। বন্ধু-বান্ধব বিশেষ করে বড় বড় ব্যবসায়ী, আমলা রাজনীতিবিদদের আহাজারি এবং তাদের জন্য কিছু করতে না পারার বেদনা আমাকে গত এক বছরে ক্রমশ নিস্তেজ ও নিষ্প্রভ করে ফেলেছে। আওয়ামী জমানাতে স্বয়ং শেখ হাসিনা যখন আমার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে আমার গাড়ি ভেঙে চুরমার করেছেন এবং দুদক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দিয়ে হয়রানি করেছেন তখনো আমি একটি মুহূর্তের জন্য হতোদ্যম হইনি। আমার বন্ধু ও শুভাকাক্সক্ষীরা যেভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাতে করে বিরূপ সময়েও আমার জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে উন্নয়ন ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্তু গত এক বছরে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি বটে, কিন্তু আমার চারদিকের প্রকৃতি ও পরিবেশের যে সর্বনাশ ঘটেছে এবং মব সন্ত্রাসের নামে জংলি সন্ত্রাসের যে বিস্তার দেখছি তাতে করে আমার চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, স্মরণশক্তি কমে গেছে, কাজ করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে এবং নতুন কিছু শুরু করার উদ্ভাবনী ক্ষমতা, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা এবং বিনিয়োগের ইচ্ছা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ফলে অখ- অবসরে যে আতঙ্ক অনুভব করছি যা ২০২৪ সালের জুলাই মাসে একদমই ছিল না।
গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে আমি ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। একটি প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিকে প্রতি সপ্তাহে শেখ হাসিনা সরকারকে তুলাধুনা করে যা ইচ্ছা তাই লিখতাম। প্রতিদিন ২-৩টা টকশো, অধিকন্তু নিজের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য দৈনিক তিনটা ভিডিও রেকর্ডিং এডিটিং আপলোডসহ যাবতীয় কাজের পাশাপাশি ৩০ বছরের পুরোনো ব্যবসার তদারকি, রাজনীতি, সামাজিক যোগাযোগ এবং সর্বোপরি অবসর বিনোদন কোনো কিছুই বাদ যেত না। প্রতি রাতে বাসায় ফিরতাম একটা দেড়টার দিকে। উত্থাল রাজপথ, সরকারি বাহিনীর সতর্ক প্রহরা, ছাত্রলীগের মহড়া, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গ্রেপ্তার বাণিজ্য-গুম, খুনের হুমকি ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও ভয়হীন চিত্ত নিয়ে দুর্বার গতিতে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট পার করেছি। কিন্তু আগস্ট মাসের ৫ তারিখ থেকে আজ অবধি আমার সেই গতি ধীরে ধীরে উধাও হয়ে কীভাবে আমাকে নির্জীব বানিয়ে ফেলেছে সে কথা বলে আজকের নিবন্ধ শেষ করব।
স্বাধীনতার পর আমার কোনোদিন মনে হয়নি আমার দেশ বিদেশি কোনো শক্তি দখল করতে আসবে। আমরা রোহিঙ্গা, সিরীয় মুসলমান কিংবা ফিলিস্তিনিদের মতো উদ্বাস্তু হতে পারি এমন দুঃস্বপ্ন কোনোকালে আমাদের তাড়া করেনি। আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ হবে আর ১৯৭৪ সালের দুর্বিষহ স্মৃতি অথবা ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো দুর্ভাগ্য আমাদের দিকে ধেয়ে আসবে এমন আতঙ্ক মস্তিষ্কে স্থান পায়নি। ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গিবাদ, সমকামিতা, চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিনি কোম্পানিকে পরিচালনা, জাতিসংঘকে করিডর দেওয়ার নামে টেকনাফ সীমান্তে অরাজকতা, সেন্ট মার্টিন নিয়ে কলিজা ছিদ্র করা কথাবার্তা শোনার পর আমার শরীর মন মস্তিষ্কের ওপর যে চাপ পড়ছে তা গত এক বছরে আমার জীবন ও কবরকে খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
আমি সারাজীবন ধনীদের কাঁদতে দেখিনি। সমাজের গুরুজন শ্রদ্ধাভাজন সমাজপতিদের ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কলা পাতার মতো থরথর করে কাঁপতে দেখিনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের দেউলিয়া হওয়ার ভয়ে সমস্বরে আহাজারি করতে দেখিনি। দেশের পুলিশের একদল ভয় পাচ্ছে, সাবেক দল পালিয়ে গেছে, একাংশ জেলে এবং অপর অংশ জেলের ভয়ে কাঁপছে। লোকজনের সেই আগের বিশ্বাস ও আস্থা নেই। মব সন্ত্রাসীরা এখনো রাগ হলে পুলিশ যাত্রাবাড়ী মডেলে পিটিয়ে মেরে টানিয়ে ঝুলিয়ে রাখার হুমকি দিচ্ছে। এমন কেউ নেই যার প্রতি জনগণের আস্থা ও নির্ভরতা রয়েছে। জাতীয় জীবনে এমন প্রিয়মুখ নেই অথবা প্রিয় কণ্ঠস্বর নেই যার জাদুকরি কণ্ঠ ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। উল্লিখিত কারণে সমাজের স্বাভাবিক বন্ধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। মাত্র এক বছরের মাথায় বিয়েশাদি-সন্তান উৎপাদন, খানাপিনা-আহার নিদ্রা, ব্যবসাবাণিজ্য বিনোদন এবং বেঁচে থাকার আগ্রহ মুখ থুবড়ে পড়েছে। সমাজের হাসি-কান্নার স্বাভাবিক সুর পরিবর্তন হয়ে উগ্র উল্লাস কিংবা অতিচিৎকারে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। পাপাচার-অনাচারের শত বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ভেদ করে নতুন এক জঘন্য ভ্রষ্টাচার শুরু হয়েছে, যা ইতিপূর্বে ছিল না। গত কয়েক মাসের ধর্ষণ, বিয়েবাড়িতে হামলা, গভীর রাতে গেরস্থের ঘরে ঢুকে যা ইচ্ছা তা করা এবং সমাজকে জঙ্গল বানানোর যে পরাকাষ্ঠা দেখা দিয়েছে, তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সবকিছু ভুলে অবোধ শিশু হওয়া ছাড়া আমার মতো অধমের আর কীইবা করার আছে।
♦ লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক