‘বেওয়ারিশ হাসপাতাল’ শব্দবন্ধে পাঠক হোঁচট খেলেও এমন অদ্ভুত অবস্থা প্রকৃতই তৈরি হয়েছে। আর তা সামনে নিয়েই প্রতিকার প্রত্যাশায় এ রচনা। সিলেট বিভাগের সর্ববৃহৎ সরকারি হাসপাতাল ওসমানী। কোটি মানুষের উন্নত চিকিৎসার আশ্রয়স্থল বলা হয় হাসপাতালটিকে। কাগজকলমে ৯০০ শয্যার হলেও প্রতিদিন এখানে সেবা নেন আড়াই থেকে ৩ হাজার রোগী। শয্যা না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দায়ও বেড পেতে সেবা দিতে হয় রোগীদের। অতিরিক্ত রোগী ও দর্শনার্থীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষকে। একই কারণে হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।
এই যখন সিলেটের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালের অবস্থা, ঠিক তখন অদূরে অসহায়ত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি আট তলা হাসপাতাল ভবন। গত সরকারের আমলে ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ভবনটি নির্মিত হয়। কিন্তু নির্মাণের পর জানা যায় হাসপাতালটি ‘বেওয়ারিশ’। এই হাসপাতালের কোনো অভিভাবক নেই। গণপূর্ত অধিদপ্তর হাসপাতাল ভবনের কাজ শেষ করার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে এটি সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহালই নয়। হাসপাতাল নির্মাণের আগে মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। তাই অভিভাবকহীন হাসপাতালটি নির্মাণ করে বিপাকে পড়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। হাসপাতালের দারোয়ান থেকে শুরু করে তত্ত্বাবধায়ক কোনো পদেই কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অভিভাবকহীন হাসপাতালটি এখন পুরোপুরি অরক্ষিত। সিলেটের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের পক্ষ থেকে কয়েক দফা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েও সমস্যার সুরাহা হয়নি। অথচ শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হাসপাতালটি চালু করা গেলে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রোগীর চাপ কমত। সেবার মান বাড়ত উভয় হাসপাতালের। উপকৃত হতো সিলেট বিভাগের মানুষ।
সিলেটে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নগরের চৌহাট্টা এলাকায় ‘সিলেট জেলা সদর হাসপাতাল’ নামে ২৫০ শয্যার একটি নতুন হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেন। প্রকল্পটি পাস করে যেতে পারলেও তাঁর মেয়াদকালে তিনি হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেননি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ৭ একর জমির ওপর হাসপাতালটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন হলেও মূলত ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গণপূর্ত বিভাগের অধীনে কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ১৩ তলা ভিতবিশিষ্ট হাসপাতালটির আট তলার কাজও সম্পন্ন হয়েছে। ভবন নির্মাণের পাশাপাশি রং, ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং, টাইলস, গ্লাস, দরজা-জানালাসহ অবকাঠামোগত অনেক কাজই ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। হাসপাতালটির নকশায় বেজমেন্টে পার্কিং, প্রথম তলায় টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিং রুম; দ্বিতীয় তলায় আউটডোর, রিপোর্ট ডেলিভারি ও কনসালট্যান্ট চেম্বার; তৃতীয় তলায় ডায়াগনস্টিক; চতুর্থ তলায় কার্ডিয়াক ও জেনারেল ওটি, আইসিসিইউ, সিসিইউ; পঞ্চম তলায় গাইনি বিভাগ, অপথালমোলজি, অর্থপেডিক্স ও ইএনটি বিভাগ এবং ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলায় ওয়ার্ড ও কেবিনের ব্যবস্থা রাখা হয়। হাসপাতালটির আট তলা পর্যন্ত কাজ শেষ হওয়ার পর এটি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। নতুন হাসপাতালটি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধীনে পরিচালিত হবে নাকি সিভিল সার্জন অফিসের অধীনে চলবে এটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু ভবন নির্মাণের আগে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এখন কেউই হাসপাতালটি পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চাইছে না। ভবনের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য গণপূর্ত বিভাগ কয়েক দফা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি পাঠালেও জটিলতার অবসান হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নির্মাণকাজ শুরুর আগে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের কথা থাকলেও গণপূর্ত বিভাগ সেটি করেনি। নিয়োগ দেওয়া হয়নি কোনো জনবল। ফলে এই জটিলতা দেখা দিয়েছে। সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. আনিসুর রহমান জানান, হাসপাতালটি নির্মাণের আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। হাসপাতালটি কে পরিচালনা করবে সে ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিলেটবাসী এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের অবসান কামনা করেন।
♦ লেখক : গণমাধ্যমকর্মী