গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় গণমাধ্যমকে। স্বাধীন গণমাধ্যম হলো গণতন্ত্রের অন্যতম পূর্ব শর্ত। গণমাধ্যম যতটা স্বাধীন হবে, গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন ততটাই সুনিশ্চিত হবে। আর এ কারণেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গণমাধ্যম সব ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে স্বাধীনভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারে। সেই মতামত কারও পছন্দ হোক না হোক।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি প্রথম জাতির উদ্দেশে ভাষণে গণমাধ্যমের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আপনারা মন খুলে সমালোচনা করুন। আমাদের দোষ-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিন।’ শুধু প্রথম ভাষণ নয়, বিভিন্ন সময় তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে। কারণ গণমাধ্যম যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীন না হবে, নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর সে কারণেই ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে যে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা তা অর্জনের জন্য, গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে কাজ করতে দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করছি যে, গণমাধ্যমকে চাপে রাখার, তার কণ্ঠরোধ করার স্বৈরাচারী সংস্কৃতি থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। গত প্রায় এক বছর ধরে গণমাধ্যমের মধ্যে একটা ভীতির সংস্কৃতি চলছে, চলছে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’। স্বাধীনভাবে, মন খুলে কথা বলার ব্যাপারে গণমাধ্যমকে সাত-পাঁচ ভাবতে হচ্ছে। গণমাধ্যমের কোনো সংবাদ পছন্দ না হলে, মিডিয়াকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ‘মব সন্ত্রাস’ মুক্ত নয় বাংলাদেশের গণমাধ্যমও।
সাম্প্রতিক সময়ে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ রাজশাহীতে একটি কথা বলেছেন, যা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। তিনি মিডিয়াকে হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘খুনি হাসিনার পক্ষে বসুন্ধরার মিডিয়া যে ভূমিকা পালন করেছে, আমরা তা ভুলে যাইনি।’ বসুন্ধরা গ্রুপের সাংবাদিকরা আবারও নগ্নভাবে অপরাধের বৈধতা দিতে মাঠে নেমেছেন। তারা আরেকটি এক-এগারো ঘটানোর ষড়যন্ত্র করছেন। জনগণ তা কখনো বরদাশত করবে না।’ তাঁর এই বক্তব্য একদিকে যেমন আবেগপ্রসূত, পাশাপাশি অজ্ঞতাপ্রসূতও বটে।
এ ধরনের মন্তব্য হাসনাত আবদুল্লাহর মতো একজন দায়িত্বশীল তরুণ নেতা যখন দেন তখন গণমাধ্যম শুধু নয়, পুরো দেশবাসী উদ্বিগ্ন হতে বাধ্য। কারণ এ ধরনের বক্তব্য কখনোই একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। বরং এ ধরনের হুমকি ফ্যাসিস্ট আমলে গণমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের কথাই মনে করিয়ে দেয়। জুলাই আন্দোলনের বীর যোদ্ধা আবেগে কোনো গণমাধ্যমের প্রতি অসন্তুষ্ট হতে পারেন কিংবা ওই মিডিয়া হাউসের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে তিনি প্রকাশ্যে একটি জনসভায় মিডিয়াকে রীতিমতো হুমকি দেবেন, এটি কল্পনা করলেও আঁতকে উঠতে হয়। তাহলে কি এনসিপি বা ছাত্রদের কোনো কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করা যাবে না? তাদের শুধু প্রশংসাই করতে হবে? আওয়ামী লীগও গত ১৫ বছর এভাবেই ভয়ভীতি দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল। তার পরিণাম সবাই জানে।
আমরা লক্ষ্য করেছি গত ১১ মাসে দেশজুড়ে মব সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। যে কোনো একজন নেতা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হুমকি দিচ্ছেন, ফেসবুকে তাকে ধমকাচ্ছেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গেই কিছু লোক জড়ো হয়ে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা করছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সাম্প্রতিক সময় বিভিন্ন মিডিয়াতে কারও বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেই ওই মিডিয়া হাউসের বিরুদ্ধে কেউ কেউ উসকানিমূলক অবস্থান নিচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। একটি পত্রিকা বা একটি গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতি আদর্শের সঙ্গে যে কোনো মানুষের বিরোধ থাকতেই পারে। একটি মিডিয়ার প্রতিবেদন যে সব রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি পছন্দ করবেন তেমন নয়, কেউ একটি প্রতিবেদন অপছন্দ করতেই পারেন। অপছন্দ করলেই কি মিডিয়াকে হুমকি দিতে হবে? একটি গণমাধ্যম যদি কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রকাশ না করে, সেক্ষেত্রে প্রতিবাদ জানানোর স্বীকৃত পদ্ধতি আছে। ‘হুমকি’ কখনো প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। সবাই যদি বিএনপি, এনসিপি কিংবা জামায়াতের প্রশংসা করে, তাদের গঠনমূলক সমালোচনা করতে ভয় পায় তাহলে আর মিডিয়ার দরকার কী? এ ধরনের হুমকি গণতন্ত্রের উত্তরণের পথেও অন্তরায়। এ রকম সংস্কৃতি চালু হলে রাজনৈতিক দলগুলো তার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো বুঝতে পারবে না। যেমন ধরা যাক জুলাই যোদ্ধাদের দল এনসিপি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এ সংগঠনটির মধ্যে অনেক রকম সমস্যা এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি মানুষ লক্ষ করেছে। এনসিপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে পাঠ্যপুস্তক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন এখন তদন্ত করছে। এনসিপিও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং তাকে দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এনসিপির আরেক নেতা সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে একজন নারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলার অভিযোগ উঠেছে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তাকেও এখন আপাতত দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির একটি ইতিবাচক দিক হলো কোনো সমালোচনাকেই তারা উপেক্ষা করছে না। যখন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন। এ জন্য এনসিপি ধন্যবাদ পেতেই পারে। কিন্তু এনসিপির এই অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য। একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে ভুলত্রুটি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এনসিপি একটি নতুন রাজনৈতিক দল এবং এই রাজনৈতিক দলের সবাই তারুণ্যে ভরপুর, নতুন এবং তাদের সৃষ্টি সুখের উল্লাস আছে। এই তারুণ্যের উচ্ছ্বাস যেন সঠিক পথে, একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক মূলধারায় পরিণত হতে পারে সেজন্য তাদের সমালোচনা করা যেমন জরুরি, তেমনি তাদের এই সমালোচনা গ্রহণ করাও অত্যন্ত জরুরি। সমালোচনা করলেই সেই পত্রিকা ফ্যাসিস্টের দালাল হয়ে যাবে বা সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে হবে, সেই পত্রিকাকে আক্রমণ করতে হবে এ ধরনের মানসিকতা কখনো গণতান্ত্রিক হতে পারে না। এমনিতেই গত ১১ মাসে গণমাধ্যমের অবস্থা ভালো নয়। শুধু ১১ মাস নয়, গত ১৬ বছর ধরেই গণমাধ্যম একটা বন্দি অবস্থায় রয়েছে। আমরা জানি যে আওয়ামী লীগ শাসনামলে মিডিয়া কীভাবে পরিচালিত হতো। হাসনাত আবদুল্লাহ নিজেই একাধিকবার বলেছেন যে মিডিয়া কন্ট্রোল করত গোয়েন্দা সংস্থা এবং আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তিবর্গ। তারা মিডিয়াতে বিরোধী দলের কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে দিতেন না। অনেক ব্যক্তি মিডিয়াতে লিখতে পারতেন না। বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ একা নয়, কোনো মিডিয়াই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, তাদের দুর্নীতি লুটপাটের কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারত না। ৫ আগস্টের আগেই বসুন্ধরা গ্রুপের একাধিক পত্রিকার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইনে বহু মামলা হয়েছে। হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বহু সংবাদকর্মীকে। এসব মামলা করেছে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতারা ও প্রশাসন। চাঁদা, মানহানির মামলাসহ বানোয়াট ফৌজদারি মামলা করেও বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়াকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল সেই সময়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত বছর ৩১ মার্চ ‘কালের কণ্ঠ’ পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীরের দুর্নীতি নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই সংবাদটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রথম ধাপ। যে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে সারা দেশ কেঁপে উঠেছিল। সারা দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে আওয়ামী লীগের আমলে কী পরিমাণ লুণ্ঠন এবং দুর্নীতি হচ্ছিল। একজন পুলিশের আইজিপি কীভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা হতে থাকে। তৎকালীন প্রশাসন এবং সরকার এই মামলাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল গণমাধ্যম যেন আওয়ামী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলম না ধরে, কথা না বলে। কাজেই হাসনাত আবদুল্লাহ যখন বলেন যে বসুন্ধরা গ্রুপের পত্রিকাগুলো ফ্যাসিস্টের দালাল তাহলে তিনি হয়তো পুরো ১৫ বছরের গণমাধ্যমের চিত্র সম্পর্কে সঠিকভাবে অবহিত নন। ১৫ বছর মিডিয়া বন্দি ছিল। সেই পরিস্থিতি থেকে মিডিয়াকে মুক্ত করতে হবে এই সরকারকে। এই তরুণদের, তাহলেই আমরা পাব কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ।
গণ অভ্যুত্থানের পর সবাই আশা করেছিল যে মিডিয়া স্বাধীন হবে এবং মিডিয়াতে সবাই মন খুলে কথা বলতে পারবে, সমালোচনা করতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে ৫ আগস্টের পর আমরা দেখছি যে মিডিয়ার ওপর নানারকম হয়রানি, মব আক্রমণ এবং হুমকি। আগেও মিডিয়াতে আতঙ্ক ছিল, এখনো আতঙ্ক আছে।
পরমত সহিষ্ণুতা হলো গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমরা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করি যে হাসনাত আবদুল্লাহ এবং তাঁর দল এনসিপি বাংলাদেশে গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার একটা ধারা তৈরি করতে চান। সেই ধারা যদি তৈরি করতে হয়, তাহলে গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতেই হবে। গণমাধ্যম যে সমালোচনা করে, সেই সমালোচনাকে উপলব্ধি করতে হবে, ধারণ করতে হবে এবং সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। যদি সেটি না থাকে তাহলে আওয়ামী লীগ থেকে হাসনাত আবদুল্লাহর পার্থক্য কী? আমরা মনে করি হাসনাত আবদুল্লাহর স্বৈরাচার পতনে বিশাল অবদান রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই তিনি আন্দোলন করেছিলেন একটি মুক্ত বাংলাদেশের জন্য, যে মুক্ত বাংলাদেশে গণমাধ্যম প্রাণ খুলে কথা বলতে পারবে। কাজেই ১৫ বছরে কে কী করেছে, সেই হিসাব যদি নেওয়া যেতে পারে তাহলে কম্বল বাছতে লোম উজাড় হয়ে যাবে। ছাত্রলীগের ভয়ে সেই সময় যারা ছাত্রলীগ সেজেছিলেন তারাও কি তাহলে ফ্যাসিস্টের দালাল? কারণ সে সময় শুধু গণমাধ্যম না সবাই প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে তৎকালীন সরকারের কথা শুনতে বাধ্য হয়েছে। না হলে তাদের ওপর খড়গ নেমে এসেছে। এই বাস্তবতা উপলদ্ধি না করে হুটহাট করে গণমাধ্যমকে আক্রমণ করা, গণমাধ্যমকে হুমকি দেওয়াটা একটি খারাপ প্রবণতা। এর ফলে পুরো গণমাধ্যম কুণ্ঠিত থাকবে। সত্য প্রকাশে সাহস পাবে না। যদি সত্য প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এনসিপি এবং হাসনাত আবদুল্লাহই।
অদিতি করিম, নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : [email protected]