বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামছে তখন। আকাশজুড়ে কালো মেঘ। সঙ্গে দমকা ঠাণ্ডা হাওয়াও। মাঝে মাঝেই সেই কালো মেঘের ভেতর দিয়ে খেলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো। ক্ষাণিক বাদেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। গাড়ি তখন উত্তরখানের মধ্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তেরোমুখ ঘাটের দিকে।
এর মধ্যেই আম্মার ফোন। জানতে পারলাম ঠাকুরগাঁওয়েও ঝড় হচ্ছে। বাসায় কেউ নেই। আম্মা একা। বিদ্যুৎ গেছে মিনিট ১০ আগে। আম্মা বসে আছে অন্ধকারময় বারান্দার মধ্যেই। আম্মার সঙ্গে কথা বলার পর বুঝলাম তার মনের অবস্থা। চার ছেলে তার। কেউ নেই এ মুহূর্তে। বড় ভাই অফিস থেকে ফিরবে কিছুক্ষণ পরেই। তবেই হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাবে আম্মা।
ফোনে; কেমন আছো আম্মা? বলতেই ওপাশ থেকে আম্মা বলল-'বাবু ঢাকায় ঝড় হচ্ছে নাকি?'-হচ্ছে আম্মা। -'তুই কোথায় বলতো বাবু? উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইলো আম্মা। আমি এই ঝড়ের মধ্যে এখনো রাস্তায় আছি শুনে স্তম্ভিত হলো বুঝলাম।-'তুই যে কবে মানুষ হবি রে বাবু, কোন সাহসে তুই এই ঝড়-বাদলের মধ্যে রাস্তায় আছিস? দাঁড়া আমি আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিয়ে দেই।'
মায়ের আদেশ শিরোধার্য। তাই গাড়িটা এক জায়গায় থামিয়ে আম্মার সঙ্গে কথা বলতে থাকলাম। কথা বলতে বলতেই বুঝলাম। আম্মা খুব একাকিত্ব বোধ করছে। হয়তো অসহায়ও ভাবছে নিজেকে। আব্বা মারা গেছে কুড়ি বছর হলো। কিন্তু তার মনের কষ্ট কখনো বুঝতে দেননি আমাদের। আম্মাকে ঢাকায় আসতে বলি। হাসতে হাসতে আম্মা বলে- 'তোদের লোকভর্তি শহরে গেলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে রে বাবু। ওখানে কারো সঙ্গে না যায় কথা বলা, না যায় গল্প করা। সবাই ব্যস্ত। পাশাপাশি ফ্লাটের লোক কেউ তোরা কাউরে চিনিস না।'
আম্মাকে বলি -'খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আম্মা তোমাকে, আমি সামনের মাসে ছুটি পেলেই চলে আসবো।
'আম্মা আস্তে করে বলে-' আয় বেটা, আমারও তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। মেলা দিন হয়ে গেল তোকে দেখি না। সারাক্ষণ তোদের কথা ভাবি। তোদের ছাড়া আমার যে কিছুই ভালো লাগে না বাবু। বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে আম্মার।'
ওপাশে কাঁদছে আম্মা। এপাশে আমার চোখ বেয়ে তখন নোনা জল। কাঁদছি আমি। বুকজুড়ে তীব্র হাহাকার অনুভব করছি। শূন্যতায় ভরে উঠেছে ভেতর বাহির। নিপাট স্বার্থপরতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে। শুধু বারবার ভেসে উঠছে আম্মার পবিত্র মায়াভরা মুখটা।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ খান জোন)।
বিডি প্রতিদিন/০৩ এপ্রিল ২০১৯/আরাফাত