বুধবার, ২২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইয়াবা ব্যবসায় প্রভাবশালীর সন্তানরা

ঢাকায় কারখানা ও ব্যবসা জমজমাট, নেপথ্যের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে

সাঈদুর রহমান রিমন

ইয়াবা ব্যবসায় প্রভাবশালীর সন্তানরা

প্রভাবশালীদের স্বজনরাই পরিচালনা করছেন ‘ইয়াবা’ তৈরির কারখানা। তারাই ঢাকাসহ দেশজুড়ে এ মরণঘাতী নেশাজাত দ্রব্যটি বাজারজাতের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের অতিলোভী নেতা-কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের সমন্বয়ে বানানো হয়েছে প্রভাবশালী ইয়াবা চক্র। রাজনৈতিক দাপট, প্রশাসনিক ক্ষমতা আর মাদকের অর্থে পরিচালিত এ ইয়াবা চক্রের প্রতাপ আকাশছোঁয়া। তাদের বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দটি করারও উপায় নেই। এ কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানা গেছে, ঢাকায় আলোচিত ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্যরা বরাবর মিয়ানমার থেকেই লাখ লাখ পিস ইয়াবা আমদানি করতেন। কিন্তু গত বছর অক্টোবর থেকে তিনটি সংঘবদ্ধ চক্র খোদ রাজধানী ঢাকাতেই ইয়াবার কারখানা স্থাপন করেছে। সেখানে উৎপাদিত লাখ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট প্রতিদিন সরবরাহ হচ্ছে দেশের বাজারে। পুলিশের মাদকদ্রব্য উদ্ধার টিমের এক কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই অন্তত ইয়াবার ৫টি নকল কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পথে ঢাকায় ইয়াবা প্রবেশ করছে।

বাংলাদেশে ইয়াবার প্রথম আমদানিকারক মাদক সম্রাট আমিন হুদার পর জুবায়ের নামের এক যুবক ইয়াবার কারখানা বসান গুলশানের নিকেতনে। কিন্তু সেসব কারখানায় ব্যাপকভাবে উৎপাদন ও বাজারজাত শুরুর আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হানা দেয় এবং বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ কারখানা আবিষ্কার করে। এরপর থেকেই আমিন হুদা, জুবায়ের ও তাদের আট সহযোগী জেলহাজতে           জেলহাজতে বন্দী রয়েছেন। তবে প্রতাপশালী একটি চক্র গত বছরের মাঝামাঝি সময় রাজধানীর গুলশানে এবং কাঁচপুর ব্রিজের অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীতে দুটি ইয়াবা কারখানা স্থাপন করে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই কারখানা দুটির কাছেও ঘেষতে পারেনি, ছুঁতে পারেনি ইয়াবা উৎপাদনকারী নব্য গডফাদারদের। কারণ এক প্রভাবশালী মন্ত্রীপুত্র তাদেরকে পেছন থেকে সহায়তা করেন। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী সরকারী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রভাবশালী মহলের সন্তান ও রাজনৈতিক কতিপয় নেতা-কর্মী বিভিন্নভাবে ইয়াবা ব্যবসাকে উৎসাহিত করছেন। ঢাকায় বিভিন্ন সিসা বারের আড়ালে ইয়াবা ব্যবসা হয়। এর বাইরে রাজধানীতে স্থাপিত একটি কারখানা থেকে প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উৎপাদিত ও বাজারজাত হয়ে থাকে। এই উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত আছে প্রায় দুই ডজন ব্যক্তি। তারা সবাই মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কোটিপতি বনে গেছেন। বছরখানেক আগেও যারা কেবলই চাঁদাবাজ, বখাটে, নেশাখোর হিসেবে পরিচিত ছিলেন তারা বৈধ আয়ের কোনোরকম পথ ছাড়াই রাতারাতি কোটিপতি হওয়ায় অনেকেই অবাক। তাদের কল্যাণে ও ইয়াবার সংস্পর্শে রাজধানীর বেশ কিছু ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যায়ের অখ্যাত নেতা-কর্মীও বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে উঠেছেন। তারা নিজ নিজ এলাকায় ইয়াবার সরবরাহ ও খুচরা বেচাকেনা তত্ত্বাবধায়ন করেই অঢেল টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। অপরদিকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজের অদূরে অভিনব কৌশলে চালানো হচ্ছে ইয়াবার কারখানা। প্রভাবশালী মহলের পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে গোদনাইলের তেলচোর সিন্ডিকেট সদস্যরা ইয়াবা ব্যবসা করছে। দুই বছর ধরে নৌপথেই সর্বত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। ঢাকায় স্থাপিত কারখানায় তরল উপাদান থেকে কেবল ইয়াবা ট্যাবলেটে রূপান্তর হয়ে থাকে। ইয়াবার তরল উপাদান তারা টেকনাফ সীমান্তপথে মিয়ানমার থেকেই সংগ্রহ করে। লবণ ও বালুবোঝাই বিভিন্ন ট্রলারের তেল মজুদের ছদ্মাবরণে ড্রাম ড্রাম তরল উপাদান অনায়াসে আনা হচ্ছে কাঁচপুর এলাকায়। সেখানে সবার চোখ ফাঁকি দিয়েই সেসব ড্রাম খালাস করে দেওয়া হয়।

সিসা হাউসের আড়ালে সর্বনাশা ইয়াবা : অভিজাত এলাকার এক প্রভাবশালীর ছেলের নেতৃত্বে রয়েছে অনেক সিসা হাউস। সেখানে প্রতি সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সিসাসহ নানারকম মাদক সেবনের পাশাপাশি চলে তরুণ-তরুণীদের উদ্যম নৃত্য, হৈচৈ, বেলেল্লাপনা। তিন বছর ধরে বাধাহীনভাবে এ নেশার আখড়া চলছে দাপটের সঙ্গেই। তারা সিসা হাউসের পাশাপাশি ইয়াবা ব্যবসা করেন। তিন বন্ধু মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার মংডুতে স্থাপিত ইয়াবা কারখানার কারিগর মোসলেমকে এনেই গুলশানে কারখানা বসানোর ব্যবস্থা করেন। সূত্র মতে, ঢাকার সকল সিসা হাউসকে উৎসাহিত করেন এই প্রভাবশালীর পুত্র। তিনি নিজেও এখন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। নগর রাজনীতির বড় অবস্থানেও আসতে চান। তার বিষয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। যেন সবাই অসহায়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা যায়, মংডু কারখানার পুরনো মেশিনপত্র দিয়ে শুরু করা ঢাকার কারখানা থেকে ঘণ্টায় আট থেকে নয় হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট প্রস্তুত করা সম্ভব। এ কারণে নতুন মেশিনপত্র সংগ্রহের চেষ্টা চলছে তাদের। ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের কারিগর মোসলেম স্থানীয় এক যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলেছে।

ইয়াবার পথপ্রদর্শক আমিন হুদা : আদালত ও র‌্যাব সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ইয়াবা ব্যবসা ও ইয়াবা তৈরির শীর্ষ গডফাদার আমিন হুদা। তিনিই প্রথম এদেশে ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন। জার্মানি থেকে এমফিটামিন নামে ইয়াবার কাঁচামাল সংগ্রহ করে দেশেই ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর র‌্যাব গুলশানের ১২৩ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় তার বাড়ি থেকে এক লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরির মেশিন, ভারতীয় ফেনসিডিল ও বৈদেশিক মুদ্রা আটক করে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় দুটি মামলা হয়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বেশি লাভ আর পুলিশের নজর এড়াতে মিয়ানমারের নাগরিক জনৈক জুবায়েরের নেতৃত্বেও রাজধানীর বুকে ইয়াবা তৈরির কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মিয়ানমার থেকে তার ২০ লাখ টাকায় আমদানি করা বিশেষ ধরনের মেশিনটি ঘণ্টায় ১৫ হাজার ট্যাবলেট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। ইয়াবা বিক্রি করে অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল টাকার মালিক হয়ে ওঠেন। রাজধানীর গুলশান নিকেতন এলাকার সড়ক-৫, ব্লক-সি এর একটি বাসার সাত ও আটতলায় দুটি ফ্ল্যাট কেনেন। পাজেরো জিপটিও তার। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল আনা হলে ঝুঁকি কম, লাভ বেশি। ইয়াবার কাঁচামাল সাদা রঙের। ময়দা বা আটা বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব কাঁচামাল সহজেই ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। তাই তারা দেশে ইয়াবা তৈরির পরিকল্পনা নেয়। নিকেতনে কেনা ফ্ল্যাটেই স্থাপন হয় জুবায়েরের ইয়াবা তৈরির কারখানা। জুবায়েরের বাড়ি কক্সবাজারের সদর থানায় বলা হলেও মূলত তিনি মিয়ানমারের বাসিন্দা। বিয়েশাদি, জীবনযাত্রা, সহায়-সম্পদ সবকিছুই তার মিয়ানমারে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার নয়, খোদ বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও গড়ে উঠছে ইয়াবার কারখানা। এ কারখানায় আসল ইয়াবার সঙ্গে ক্ষতিকর উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে নকল ইয়াবা। র‌্যাবের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য। জুবায়েরের কারখানা আবিষ্কারের আগেও ২০১৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাঁশপট্টি গলির ১২০ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ডিবি পুলিশ ইয়াবাসহ ভেজাল ওষুধের আরেকটি কারখানার সন্ধান পায়। ওই কারখানা থেকে সহস্রাধিক ইয়াবা, কাঁচামাল, সরঞ্জামসহ চারজনকে আটক করা হয়। কারখানাটির মালিক ছিলেন জনৈক আলী আকবর। আটকের পর আলী আকবর জানিয়েছিলেন, তিনি শুরুতে ওষুধের নকল কারখানা স্থাপন করলেও চাহিদা থাকায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় ইয়াবা উৎপাদন করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করে আসছিলেন। এ ছাড়া একই বছর চট্টগ্রামের বাকলিয়ার রসুলবাগ এলাকাতে ইয়াবা তৈরির নকল কারখানা আবিষ্কার করে পুলিশ। ওই কারখানার মালিক শ্যামল মজুমদারকে আটকের পর ৫ হাজার পিস নকল ইয়াবা ও ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২০১২ সালে রাজধানীর মধ্য বাসাবো এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবা তৈরির আরেকটি কারখানা আবিষ্কার করে পুলিশ। এ ব্যাপারে ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গোপন আস্তানার সন্ধান আমরা পেলে অভিযান চালাই। এখানে অনেক গোপন আস্তানা আছে। কারখানা করেও কেউ ইয়াবা তৈরি করতে পারে। তবে সব খবর হয়তো আমাদের কাছে নেই। গোয়েন্দা তত্পরতা এবং অভিযান চালানোর কাজে তাদের দুর্বলতা আছে বলে স্বীকার করেন।’

তিন গুণ লাভে ধনাঢ্য অনেকেই : বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া নকল ইয়াবা কারখানার মালিকরা জানান, সোডিয়াম বেনজোয়েট, ক্যাফেইন ও ভেনিলার পাউডার মিশিয়ে তারা নকল ইয়াবা তৈরি করেন। অনেক সময় ছোট আকারের ওষুধ কোম্পানি থেকে ইয়াবা সাইজের ট্যাবলেট তৈরি করিয়ে সেসব ট্যাবলেটে শুধু ইয়াবার ফ্লেভার (গন্ধ) মিশিয়ে তা বাজারজাত করা হয়। এসব নকল ইয়াবা প্রস্তুত করতে খরচ পড়ে প্রতি পিস ৩০ টাকা। এগুলো পাইকারিভাবে বিক্রি করা হয় ৯০ টাকা থেকে ১১০ টাকা দরে। তবে রাজধানীতে ইয়াবা ট্যাবলেট প্রতি পিস খুচরা বিক্রি হয় আড়াইশ থেকে তিনশ টাকায়। মাদকের এই চেইন বাণিজ্যে পুঁজির তিন গুণ লাভে রাতারাতি ধনাঢ্য হয়ে উঠছেন অনেকেই। ফলে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও অন্যান্য পেশার শিক্ষিত অনেকেই ইয়াবা কেনাবেচার কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। ইয়াবার পাইকারি ও খুচরা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা ইয়াবার সঙ্গে ঢাকায় তৈরি ইয়াবার সূক্ষ্ম পার্থক্য বোঝার উপায় নেই। খুব ভালোভাবে পরখ করলে দেখা যায়, রং কিছুটা বদলে যায়, ফ্লেভারও কম থাকে। তবে সেবনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো হেরফের নেই বললেই চলে। সেবনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, হালকা রঙের ইয়াবা সেবনে নেশা হয় বেশি, তবে মাথাব্যথার সূত্রপাত ঘটে। গ্রাহক পর্যায়ে ঢাকায় ইয়াবা তৈরির বিষয়টি নিয়ে জানাজানি নেই বললেই চলে। তারা জানেন, মিয়ানমার থেকেই তিন-চার রকমের ইয়াবা ঢাকায় আমদানি হয়ে থাকে। সেগুলোর দামেও হেরফের আছে। ঢাকার বাজারে দুই ধরনের ইয়াবা পাওয়া যায়। একটি অবৈধ পথে ঢাকা আসে, আরেকটি উৎপাদন হয় ঢাকায়। মাঝে মাঝে অভিযান হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সর্বশেষ খবর