বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বিতর্কিত ভূমিকা নেওয়া তৎকালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার নতুন করে মুখ খুলেছেন। দাবি করেছেন, মার্কিন চাপে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিতে সম্মত হয়েছিল পাকিস্তান। মার্কিন ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিকের সর্বশেষ সংখ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে কিসিঞ্জার বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিতে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান দিন দিন বাড়ছিল। একপর্যায়ে নভেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে এক সাক্ষাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পরের মার্চে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিতে সম্মত হন। যদিও ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল আমেরিকা। এমনকি তৎকালীন পাকিস্তানি জান্তার পক্ষে নিজেদের সপ্তম নৌবহর পাঠায় দেশটি। পরে দৃশ্যত সোভিয়েত চাপে এ অবস্থান থেকে সরতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র।
দ্য আটলান্টিকের প্রধান সম্পাদক জেফ্রে গোল্ডবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিসিঞ্জার বলেছেন, ১৯৬৯ সালে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শুরুর প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালে। এরই মাঝে চীনের সঙ্গে খুবই গোপনীয় কিছু বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আর এসব বৈঠক পাকিস্তানের মাধ্যমেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পাকিস্তান তখন ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী ছিল। বাঙালিদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রচেষ্টার মোকাবিলায় পাকিস্তানি বাহিনী ‘চরম সহিংসতা’ ও ‘স্থূল মানবাধিকার লঙ্ঘন’ করেছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন। তার ব্যাখ্যা, এসব প্রকাশ্যে নিন্দা জানালে পাকিস্তানি চ্যানেল ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শুরুর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আরও কয়েক মাস পাকিস্তানের ওই চ্যানেলটি দরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এ প্রক্রিয়া শুরুই করেছিল পাকিস্তান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ট্র্যাজেডি প্রত্যক্ষ করা মার্কিন কূটনীতিকরা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শুরুর প্রক্রিয়ার কথা জানতেন না। তারা যে পরিস্থিতির বর্ণনা পাঠিয়েছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত হূদয়গ্রাহী ও যৌক্তিক। কিন্তু আমরা প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারিনি। অবশ্য আমরা বিপুল পরিমাণ খাদ্য দিয়েছি এবং সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। কিসিঞ্জারের মতে, পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশকে স্বায়ত্তশাসন দিতে পাকিস্তানকে আহ্বান জানানো বাড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নভেম্বরে নিক্সনের সঙ্গে সাক্ষাতে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পরবর্তী মার্চে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিতে সম্মত হন। তার দাবি, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সামরিক ধারাসহ একটি চুক্তি সম্পন্ন করার পর শরণার্থীদের চাপ কমাতে ডিসেম্বরে ভারত পূর্ব-পাকিস্তান আক্রমণ করে। তখন সোভিয়েত চাপ, ভারতের উদ্দেশ্য, চীনের সন্দেহ ও পাকিস্তানের জাতীয়বাদ— সব কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। তখন অনেক সমঝোতা করতে হয়েছিল, যা বলতে গেলে একটি বই লাগবে। কিন্তু এর ফল যা হয়েছে তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।