বাঙালির জাতীয় জীবনে মার্চ মাস অবিস্মরণীয় একটি মাস। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে বরকত, সালাম, রফিক ও জব্বারের জীবনদানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উন্মেষ ঘটেছিল তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ’৭১ সালের এই মাসে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ’৫৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগ শোচনীয় পরাজয়বরণ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্র যুক্তফ্রন্টকে ক্ষমতায় টিকতে দিল না। সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা জবরদখল করে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে গণবিরোধী অদ্ভুত প্রথা চালু করেন। এই প্রথা আর আইয়ুবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম সংঘটনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন তরুণ নেতা শেখ মুজিব। বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ ছয় দফা তুললেন তিনি। তখন পাকিস্তানিরা তাকে খতম করে দেওয়ার জন্য ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দিল। গণআন্দোলনের মুখে তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সারা পাকিস্তান শাসনের ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ক্ষমতা দেওয়া হলো না। বাংলাদেশের মানুষ গর্জে উঠল। স্লোগান দিল ‘ভুট্টোর মাথায় লাথি মারো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বেই ধাপে ধাপে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও প্রস্তুত করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে এগিয়ে যেতে। এই এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল ১ মার্চ। ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ঘোষণা করলেন, অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিলাম। ইয়াহিয়ার ঘোষণা বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লাম, ক্রিকেট ম্যাচ বন্ধ করে দিলাম। ঢাকা নগরীর সর্বত্রই চলছে বিক্ষোভ। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলো। বঙ্গবন্ধু তখন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভা করছিলেন। সভা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের ব্রিফিং করলেন, ডাক দিলেন হরতালের। শুরু করলেন অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন জেলা শহরে জনতার বিক্ষোভ মিছিলের ওপর গুলি করে। গুলিতে অনেক মানুষ প্রাণ হারায়। তবু তারা কারফিউ ভেঙে মিছিল করতে থাকে। এ অবস্থায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক দলগুলোর গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন। ওই সময়টায় বঙ্গবন্ধু আমাদের সাবধানে থাকবার পরামর্শ দিতেন। বলতেন পাকিস্তানিরা যে কোনোভাবেই বিশৃঙ্খলা করে আন্দোলন ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। পাকিস্তানিরা ছিল পাকা খেলোয়াড়। যখনই বাঙালি কোনো আন্দোলনে নেমেছে, তখনই তারা কোনো না কোনো অঘটন ঘটিয়েছে। কখনো বাধিয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কখনো লাগিয়েছে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা। বঙ্গবন্ধু ৬ মার্চ দুপুর ২টা পর্যন্ত একটা হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। সে সময় পাকিস্তানিরা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় গুলি চালাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিলেন। তিনি যেমন আন্দোলন-সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন তেমনি আলোচনার মাধ্যমে সংকট মোচনেও বিশ্বাসী ছিলেন। সে কারণেই ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকায় এলে তিনি তাদের সঙ্গে আলোচনায় শামিল হয়েছিলেন। একসময় তার হুকুমেই চলেছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন। এ অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চ তিনি দিলেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ। লাখ লাখ মানুষের সামনে মাত্র ১৯ মিনিটে তিনি অলিখিত এক জাদুকরি ভাষণ দেন। পিনপতন নীরবতায় জনতা সেই স্মরণীয়-বরণীয় ভাষণটি গভীর মনোযোগে শুনেছে। অনেকেই বলেন, এটা শুধু ভাষণ নয়, এ এক মহাকাব্য। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করেছিলেন কিন্তু তার আগে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার, দুশমনদের পানিতে ও ভাতে মারার নির্দেশ দেন। তাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করতে পারে অনুমান করে বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা থামবে না’। আজকাল অনেকেই ওই ভাষণ সম্পর্কে অনেক কথা বলেন। তারা আসলে জ্ঞানপাপী। ওই ভাষণে যে স্বাধীনতার কথা ছিল জ্ঞানপাপীরা তা স্বীকার করে না। জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোয় ছাত্রদের সংগঠিত করি। যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে এমন চিন্তা মাথায় রেখেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকরা প্রশিক্ষণ নেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আক্রমণ করে। প্রথমে আক্রমণ চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। আমার বাসা সে সময় রাজারবাগে ছিল। দেখেছিলাম কীভাবে বাঙালি পুলিশের ওপর ওরা নিষ্ঠুর আক্রমণ চালিয়েছিল, গুলি করে বোমা মেরে পুলিশ হত্যা করেছিল। বাঙালি পুলিশও পাল্টা আক্রমণ চালায়। যতক্ষণ গুলি ছিল ততক্ষণ তারা প্রতিরোধ চালিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনী কমলাপুর রেলস্টেশন, পিলখানা, সদরঘাটে ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করে। নির্বিচারে তারা গণহত্যা চালায় সারা দেশে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিছুক্ষণ পরই তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানিরা। কারফিউ জারি করে সারা দেশে। পরদিন দুপুর পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফার কাছে যাই। তিনি আমাদের দিকনির্দেশনা দেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকি। অনুলিখন : রফিকুল ইসলাম রনি।
শিরোনাম
- সাড়ে ৯ ঘণ্টা পর ঢাকা-ময়মনসিংহে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে খালেদা জিয়া
- সাদিয়া আয়মানের অভিনয়ে মুগ্ধ অনিরুদ্ধ রায়
- গাইবান্ধা কারাগারে অসুস্থ হয়ে আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু
- আদাবরের শীর্ষ ছিনতাইকারী ‘চোরা রুবেল’ গ্রেপ্তার
- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
- শিক্ষার্থীদের বাড়ি পৌঁছে দিতে বিভাগীয় শহরে বাস দিল জবি
- ভূমিকম্প অনিশ্চিত তাই বিদ্যালয় বন্ধের সুযোগ নেই: প্রাথমিক শিক্ষা উপদেষ্টা
- ঢাকা মেডিকেলে একাডেমিক কার্যক্রম আগামী ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত বন্ধ
- বাগেরহাটে ৩ বান্ধবীকে শ্লীলতাহানি ও একজনকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
- হাসিনা-কামালকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি দেওয়া হয়েছে : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
- পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ কার্নিভাল-৩ অনুষ্ঠিত
- নভেম্বরের ২২ দিনে রেমিট্যান্স এলো ২১৩ কোটি ডলার
- ফ্যাসিজম সহ্য করা হবে না, নিজেরাও ফ্যাসিষ্ট হবো না: তানিয়া রব
- বন্ধ কারখানা চালুর দাবিতে শ্রমিকদের মানববন্ধন
- ৮১ দেশি পর্যবেক্ষকের সঙ্গে ইসির সংলাপ ২৫ নভেম্বর
- ‘ফ্যামিলি ম্যান থ্রি’: মনোজ নয়, জয়দীপের সিজন?
- টিকটক ইউজারদের জন্য চালু হলো টাইম অ্যান্ড ওয়েল-বিয়িং ফিচার
- পটুয়াখালীতে হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার দাবিতে মানববন্ধন
- বাংলাদেশের কাল ব্রুনাই চ্যালেঞ্জ
জাতির প্রেরণার উৎস ৭ মার্চের ভাষণ
মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু
Not defined
প্রিন্ট ভার্সন
টপিক
এই বিভাগের আরও খবর