বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সাইবার ক্রাইম

আরাফাত মুন্না

ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সাইবার ক্রাইম

ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে পড়ছে সাইবার জগৎ। ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে অপপ্রচার চালানো, ছবি বিকৃতি এবং কুৎসা রটানোর মাধ্যমে অন্যের সম্মানহানি ঘটানো যেন এখানে অতি সাধারণ ব্যাপার। ছোটখাটো বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারের পাশাপাশি চলছে জঙ্গিবাদের উসকানিও। এসব ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পাশাপাশি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। সংঘবদ্ধ একটি চক্র, রাষ্ট্র ও সমাজের সম্মানীয় ব্যক্তিদের হেয় করার চেষ্টা করে চলছে অনবরতভাবে। এ ছাড়া কারও নামে সংঘবদ্ধভাবে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইনের চোখে অপরাধী বানানোরও অপচেষ্টা করা হয়। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এসব অপরাধ এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করে এমন তথ্যই মিলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের শক্ত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না থাকা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় সাইবার অপরাধের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। ঘটনাগুলো এখন শুধু ভার্চুয়াল জগতেই নেই, জাতীয় নিরাপত্তায়ও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক দিনে ফেসবুকে অপপ্রচার ও গুজব যেভাবে বেড়েছে, তাতে সাময়িক সময়ের জন্য এ সাইটটিকে বন্ধ করা যেতে পারে বলেও মত তাদের।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জনপ্রিয় তারকাদের ছবি ব্যবহার করে ভুয়া পরিচয়ে ফেক ফেসবুক পেজ খোলা হয়। অনেকে তারকাদের ছবি দেখে সেই পেজে যান। মূলত এসব পেজ থেকে যারা গুজব ছড়ায়, তাদের ৮০-৯০ শতাংশের টার্গেট সরকার, প্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধ। অনেকে সরকারের জনপ্রিয় পরিকল্পনাকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাইট ও অ্যাপসগুলোর মধ্যে ফেসবুকের মাধ্যমেই সাইবার অপরাধের ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। এ ছাড়া কিছু অখ্যাত অনলাইন পোর্টালও নানা ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, গুজব ছড়ানোর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের হাত রয়েছে। নিজের পরিচয় লুকাতে অনেক কুৎসা রটনাকারী ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করেন। ফলে তাদের শনাক্ত করা জটিল হয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইন যেমন শক্ত না, যেটুকু আছে তারও যথাযথ ব্যবহার হতে দেখছি না। তাই সাইবার অপরাধ বাড়ছে। তিনি বলেন, আমরা দেখছি, ফেসবুকের মাধ্যমে নানাভাবে মানুষকে হেনস্তা করা হচ্ছে। কুৎসা রটিয়ে সম্মানহানির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারকে নানা ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতেও একটি গ্রুপ ফেসবুকে সক্রিয় আছে। তিনি আরও বলেন, দেশের সামাজিক অপরাধ রোধ করতে হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কঠিন ভাষায় কথা বলতে হবে। তারা সহযোগিতা না করলে প্রয়োজনে ফেসবুক এ দেশে বন্ধ করে দিতে হবে। সাইবার অপরাধ ঠেকাতে হলে সরকারের সর্বোচ্চ মনিটরিং জরুরি বলেও মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মাদ আলী শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে সাইবার ক্রাইম এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যেটা এখন শুধু সাইবার জগতেই নেই, জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবেও দাঁড়িয়েছে। নানা ধরনের গুজব অপপ্রচার ছড়িয়ে সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে নানা ধরনের দুর্ঘটনা, সংঘাত এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। তিনি বলেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় দুর্বৃত্তদের মনে ভয়টা কেটে যায়। অপরাধীরা মনে করে, আইনের ওপর যেমন তাদের হস্তক্ষেপ রয়েছে, বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও তারা পার পেয়ে যাবে। তাই সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে অপরাধীদের মনে ভয় ধরাতে হবে। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকাই এ ধরনের অপরাধ কমছে না বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ আইনে সাজা হয়েছে, এমন ঘটনা খুব একটা নেই। ফলে এ অপরাধ করলে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে সেটা অপরাধীরা বুঝতে পারছে না।

আইনে কঠিন সাজা : সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে সরকার। এই আইনের বিভিন্ন ধারায় সাইবার ক্রাইমের জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইনের আওতায় কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা চালায়, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও ১ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও ১ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে,  তাহলে  ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটালে, মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর