দৃশ্যপট-১ : গত ২১ অক্টোবর মালয়েশিয়াভিত্তিক টিটিজায়া, গ্রিনল্যান্ড গ্রুপ, ওয়ার্ল্ড লিন চেম্বার অব কমার্স, বিআরসি গ্লোবালের আট সদস্যের এক প্রতিনিধি দল বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কার্যালয়ে এর নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজেরাই বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
দৃশ্যপট-২ : একই দিন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন বিডায় গিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্যে পাঁচ লাখ ব্রিটিশ বাংলাদেশি বসবাস করেন। তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। দৃশ্যপট-৩ : ১৭ অক্টোবর সৌদি আরবের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি দক্ষ ও আধুনিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং সৌরবিদ্যুৎ খাতে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে। এ আগে প্রতিনিধি দলটি বিডার সঙ্গেও বৈঠক করে।
দৃশ্যপট-৪ : ৩ অক্টোবর নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভেরাওয়েজ বিডায় বৈঠক করে জানান, তার দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি, শিপবিল্ডিং এবং কৃষি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়।
বিডা সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৩০ দিনে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে বিডা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে বৈঠক করেছে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার মতো বড় বিনিয়োগে আগ্রহী দেশগুলো। কারণ এই দেশগুলোর বিনিয়োগকারীরা দেখছেন বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের আকর্ষণীয় স্থান। প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে জিডিপি। রপ্তানি, রেমিট্যান্স সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতেও রয়েছে ইতিবাচক প্রভাব। এ ছাড়া ব্যবসা ও বিনিয়োগে আগে যেসব বাধা ছিল, সেগুলো সহজ করার বিষয়ে কাজ করছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের ইজি অব ডোয়িং বিজনেস সূচকেও বাংলাদেশের বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। এসব কারণে বিনিয়োগকারী দেশগুলোর নজর এখন বাংলাদেশে।
শুধু যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার কারখানার মতো বড় বড় খাতগুলোতে বিনিয়োগের প্রস্তাব আসছে তা নয়, স্বাস্থ্য, আবাসনের মতো সেবা খাতে বিনিয়োগেও সম্পৃক্ত হচ্ছে চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরা। এরই মধ্যে ঢাকায় চাকরিজীবীদের কমমূল্যে আবাসনের সুযোগ করে দিয়েছে চাইনিজ একটি কোম্পানি। জাপানি ফোর বিলিয়ন হেলথ কোম্পানি লিমিটেড ‘মাই সেবা’ নামে রাজধানীতে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম শুরু করেছে, যারা জাপানি প্রযুক্তিতে স্বল্পমূল্যে বডি চেকআপসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো। দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং গ্লোবাল হ্যান্ডসেট কোম্পানি বাংলাদেশে মোবাইল তৈরির কারখানা স্থাপন করেছে। গত বছর স্যামসাং ফোনের এদেশীয় পরিবেশক ফেয়ার ইলেকট্র্রনিক্স নরসিংদীতে একটি মোবাইল সংযোজন কারখানা স্থাপন করেছে। স্যামসাং বাংলাদেশ ফ্ল্যাগশিপ ডিভাইস বাদে অন্যান্য সব সিরিজের হ্যান্ডসেট সংযোজন করছে বাংলাদেশে তাদের নিজস্ব কারখানা থেকে। নরসিংদীতে স্থাপিত ৭,৮৩,০০০ বর্গফুট আয়তনেরও বেশি জায়গাজুড়ে স্থাপিত এই কারখানাটিতে গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের স্মার্টফোন তৈরি করা হবে।
এরই মধ্যে বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাণকারী জাপানি কোম্পানি হোন্ডা বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করে মোটরসাইকেল নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেছে। দেশে হোন্ডা বাংলাদেশ লিমিটেড (বিএইচএল) নামে যৌথ উদ্যোগে কোম্পানি খুলেছে তারা। এর অংশীদার সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি)। নতুন কারখানায় আপাতত বছরে এক লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি করেছে হোন্ডা, যা ২০২১ সালে দুই লাখে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এখন তারা নতুন কারখানায় উৎপাদিত মোটরসাইকেলে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ বা বাংলাদেশে তৈরি কথাটি লিখে মোটরসাইকেল বাজারজাতকরণের উদ্যোগ নিচ্ছে।
কেন বাংলাদেশ : বিডা সম্প্রতি জাপানি রাষ্ট্রদূত হিরোয়াসু ইজুমির কাছে জানতে চেয়েছিল, কেন তার দেশের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়? এর জবাবে জাপানি রাষ্ট্রদূত যা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি ত্রিভুজের মাঝে অবস্থিত। আমি এটিকে প্রবৃদ্ধির ত্রিভুজ বলতে চাই। চীন, ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়া এই তিনটি বৃহৎ অঞ্চলের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান। যার প্রায় ১৬ কোটির মতো একটি বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। ফলে আমি মনে করি এই দেশটির এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। হিরোয়াসু ইজুমি বলেন, বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সুযোগের মুখোমুখি রয়েছে। দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার চেয়েও বেশি। শুধু তাই নয়, এটি পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি। গ্রামীণফোনের সিইও মাইকেল ফোলির কাছেও জানতে চেয়েছিল বিডা, কেন বাংলাদেশ? এর জবাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফোন সেবাদানকারী এই সংস্থাটির এ দেশীয় প্রধান বলেন, ধারাবাহিকভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের নিম্নবিত্তকে মধ্যবিত্তে উন্নীত করছে এবং এই প্রবৃদ্ধি কখনো কমছে না। অনেকেই এটিকে ‘মিরাকল’ বলতে পারেন। তবে আমি মনে করি, এটি হচ্ছে ভবিষ্যৎ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নীতি নির্ধারণ এবং সম্পাদনের অংশীদারিত্ব- যেটি এ দেশের মানুষ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত দশ বা বারো বছর ধরে চলমান রেখেছে।