রবিবার, ৩০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

সিলেটে চার ঘণ্টার ব্যবধানে চারবার ভূমিকম্প

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’, দক্ষিণে ‘শাহবাজপুর ফল্ট’। এ দুই ফল্টের মাঝখানে থাকা সিলেটের মানুষ এখন মহা-আতঙ্কে। গতকাল চার ঘণ্টার ব্যবধানে চারবার অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পে এ আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা বহন করে। আগামী তিন-চার দিন সিলেটের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ডাউকি ফল্টে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হলে সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় গতকাল সিলেট সিটি করপোরেশন আগামী সতর্কতা হিসেবে জরুরি বৈঠক করেছে। নেওয়া হয়েছে বিশেষ সতর্কতা।

সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে প্রথমবারের মতো ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর ১৪ মিনিট পর ১০টা ৫০ মিনিটে ফের অনুভূত হয় কম্পন। এরপর বেলা ১১টা ৩০ মিনিট ও বেলা ১টা ৫৮ মিনিটে আরও দুই দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়। তবে আবহাওয়া অফিস চারবার ভূমিকম্পের কথা বললেও সাধারণ মানুষের দাবি, তারা অন্তত ছয়বার এই কম্পন অনুভব করেছেন। সাধারণ মানুষের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আবহাওয়া অফিস বলছে, রিখটার স্কেলে ২ মাত্রার কম কম্পন অনুভূত হলে সেটিকে ভূমিকম্প হিসেবে রেকর্ড করা হয় না। গতকালের চারটি ভূমিকম্পের মধ্যে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের কম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ১। বাকিগুলোর মাত্রা ছিল কম।

এদিকে ভূমিকম্পের সময় মানুষ আতঙ্কে বাসা-বাড়ি ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে নেমে আসেন। অনেকে বহুতল ভবন ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের একতলা বাসা-বাড়িতে আশ্রয় নেন। ফের বড় রকমের ভূমিকম্পের আশঙ্কায় অনেকে সিলেট শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে পরিবার নিয়ে চলে যান। নগরীর মেন্দিবাগের বাসিন্দা জুনেদ আহমদ চৌধুরী জানান, তিনি সাততলা ভবনের পঞ্চম তলায় থাকেন। পরপর চার-পাঁচবার ভূমিকম্পের কারণে তার পরিবারের সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

 তাই সবাইকে নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। এদিকে গতকাল চার দফা ভূমিকম্প হলেও এর আয়তন ছিল সিলেট শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী গোলাপগঞ্জ উপজেলার জসিম উদ্দিন ও লামাকাজির তাপস দাশ পুরকায়স্থ জানান, তাদের এলাকায় ভূকম্পন অনুভূত হয়নি।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, চারটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট। একই স্থানে না হলেও উৎপত্তিস্থল ছিল পাশাপাশি। সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট, ১০টা ৫০ মিনিট, ১১টা ৩০ মিনিট ও বেলা ১টা ৫৮ মিনিটের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে যথাক্রমে ৩, ৪.১, ২.৮ ও ৪। তিনি জানান, ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল ১৩ কিলোমিটার। তাই এর আয়তন ছিল সীমিত।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম জানান, চার ঘণ্টার ব্যবধানে চার-পাঁচবার ভূমিকম্প হওয়া খুবই খারাপ লক্ষণ। ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। তাই সিলেটের জন্য আগামী তিন-চার দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে সিলেটে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, সিলেট নগরে নতুন যেসব বহুতল ভবন হয়েছে সেগুলো নিয়ম মেনে হয়েছে। কিন্তু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পুরনো ভবনগুলো। ডাউকি ফল্ট বা আশপাশ এলাকায় ৬ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হলে সিলেটে ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর ৭ বা এর ওপরের মাত্রার হলে সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে আগামী কয়েক দিন সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগকে। এদিকে পর পর কয়েকবার ভূমিকম্প হওয়ায় বড় দুর্যোগের আশঙ্কায় বিকালে সিটি করপোরেশন আগাম সতর্কতামূলক সভা করেছে। সভায় সেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকেও প্রস্তুত থাকতে সিটি করপোরেশন থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সিলেট থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ডাউকি ফল্টের অবস্থান। অন্যদিকে শাহবাজপুর ফল্টও সিলেটের কাছাকাছি। তাই ভৌগোলিক কারণে ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোনে রয়েছে সিলেট। ইতিহাসের তথ্য বলছে, ১৫৪৮ সালে প্রচ- ভূমিকম্পে সিলেট এলাকায় ভূ-আকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই সময় উঁচু-নিচু ভূমি পরিণত হয় সমতল ভূমিতে। পরবর্তীতে ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ ও ১৮৬৯ সালে হওয়া ভূমিকম্পে সিলেটের ভূ-মানচিত্র পাল্টে যায় অনেকটাই। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকালে সিলেটে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, সেটি ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়াক’ নামে সমধিক পরিচিত। ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। ভয়াবহ সেই ভূমিকম্পে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। ওই ভূকম্পনই সিলেটজুড়ে বিশালাকারের হাওর, বিল, জলাশয়ের সৃষ্টি করে। এদিকে গেল শতাব্দীতে সিলেট অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই সংঘটিত হয় এই ভূমিকম্প।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর