বুধবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুঘলকি কাণ্ড

৩৯টিতে ভিসি, ৮২টিতে প্রো-ভিসি ও ৫১টিতে ট্রেজারার নেই

আকতারুজ্জামান

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুঘলকি কাণ্ড

ভিসি, প্রো-ভিসি আর ট্রেজারার ছাড়াই চলছে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিবেদনে এমনটাই দেখা গেছে। অভিযোগের শেষ নেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। নিয়ম-নীতি মেনে চলতে তাদের বড়ই অনীহা। অনুমোদনহীন শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা, স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে অনীহা, এক প্রোগ্রামের অনুমোদন নিয়ে অবৈধভাবে অন্য প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তি, ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব, সার্টিফিকেট বাণিজ্যসহ দেদার অভিযোগ আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে। বছরের পর বছর আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়া তাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইউজিসি-সূত্র বলছেন, দেশে বর্তমানে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এর ৩৯টিতে ভিসি, ৮২টিতে প্রো-ভিসি ও ৫১টিতে ট্রেজারার নেই। আর ২১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ তিনটি পদই শূন্য রয়েছে। রাষ্ট্রপতি তথা চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়াই অথবা ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে বছরের পর বছর পার করছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। এতে একদিকে যেমন প্রশাসনিক কার্যক্রম ভেঙে পড়ছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার মান ও স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইউজিসি বলছে, শীর্ষপদ ফাঁকা থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনেক অনিয়মই হচ্ছে। আর অনিয়ম করতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় নিয়োগ দিচ্ছেন না।

সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েটদের সনদপত্র বিতরণের ক্ষেত্রে চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যই সনদে স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বা অন্য কেউ উপাচার্যের পক্ষে স্বাক্ষর করে সনদ তুলে দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের হাতে। ইউজিসি-সূত্র বলছেন, উপাচার্য না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েটদের বিতরণ করা সনদগুলো আইনগতভাবে বৈধ হবে না।

জানা গেছে, ভিসি না থাকার তালিকায় যেসব বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলো হলো- ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগাং ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি খুলনা, রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ, ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বরিশালসহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।

সাময়িক অনুমোদনপ্রাপ্ত কিন্তু শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়নি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভিসির পদ শূন্য রয়েছে আহ্ছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি রাজশাহী, মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লায়।

২১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার কোনো পদেই কর্তাব্যক্তি নেই। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগাং ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বরিশাল, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা, খুলনা খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী, মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আহ্ছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি।

চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রো-ভিসি নেই মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সিটি ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি খুলনা, ফেনী ইউনিভার্সিটি, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, রাজশাহী সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এ ছাড়া ট্রেজারার নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে- সেন্ট্রাল উইমেন’স ইউনিভার্সিটি, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, পু-্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ফার্স্ট ক্যাপিট্যাল ইউনিভার্সিটি, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়, টাইমস ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি, দি ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স, এনপিআই ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটিসহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতে প্রস্তাব পাঠাচ্ছে না। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব পদের জন্য অযোগ্য ব্যক্তিদের প্রস্তাব পাঠান, যেগুলো আমলে নেওয়া সম্ভব হয় না। আমরা শীর্ষ এসব পদের নিয়োগ নিয়ে কঠোর হতে চাই। ভিসি ও ট্রেজারার ছাড়া তো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব শীর্ষপদে নিয়োগ দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন।’ তিনি বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন না মেনে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে দেওয়া হবে না।’ ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উদ্যোক্তা বা ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃপক্ষ কেন ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারের মতো পদে নিয়োগ দিতে চান না তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা শিগগিরই শীর্ষপদ ফাঁকা থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করব।’

সর্বশেষ খবর