রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

চাঁদাবাজির যত খাত

বাড়ি নির্মাণ দোকান আড়ত টার্মিনাল কারখানা রেস্টুরেন্ট ফুটপাথ সর্বত্র চাঁদাবাজি । চাঁদা চাইলে পুলিশকে জানান : ডিবি প্রধান

বিশেষ প্রতিনিধি

চাঁদাবাজির যত খাত

রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় অবাধে চলছে চাঁদাবাজি। বাড়ি নির্মাণ, ড্রেন, রাস্তা বা ঠিকাদারি কাজ, জমি. দোকান ও ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে ফুটপাথের দোকান, জমিতে বালু ভরাট, কাঁচাবাজার, মাছের আড়ত, ফলের আড়ত, বাস টার্মিনাল, বাসস্ট্যান্ড, অটোরিকশা  ও সিএনজি স্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, রেস্টুরেন্ট, শিল্প এলাকায় ঝুটসহ সর্বত্র চলছে নিয়ন্ত্রণহীন চাঁদাবাজি। কখনো কখনো এসব চাঁদাবাজি চলে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে। এমনকি হিজড়ারাও নগরীর উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি করছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, চাঁদাবাজিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে নগরীর জনজীবন। যাদের বিরুদ্ধে এসব চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে বা বিভিন্ন সময় পুলিশের হাতে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অধিকাংশই সরকারি দল বা অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী কিংবা তাদের আশ্রিত মাস্তান বাহিনীর সদস্য। নানামুখী চাপের কারনে অনেক ক্ষেত্রে থানা পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কেউ চাঁদা চাইলেই যাতে ৯৯৯ বা নিকটস্থ থানায় কিংবা র‌্যাবের ক্যাম্পে অবিহত করা যায় পুলিশ-র‌্যাব এ বিষয়ে আইনী ব্যবস্থা নেবে। আর রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদাবাজি কররে তাদের বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স বলে ঘোষণা দিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা। 

নগরীতে বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যখনই কেউ কারও কাছে চাঁদা দাবি করে সঙ্গে সঙ্গে থানা পুলিশকে অবহিত করুন। থানা পুলিশ অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছে। পাশাপাশি ডিবি পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অভিযান পরিচালনা করছে। এ ছাড়া ডিবি পুলিশ নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।’ ডিএমপির তেজগাঁও ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি)

  বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। সে যেই দলেরই হোক। চাঁদা দাবীর কোন ধরণের অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সব ধরণের চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ তৎপর আছে।’ চাঁদা চেয়ে না পাওয়ায় ১০ অক্টোবর উত্তরখান ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহাদাত আহম্মেদ সাব্বির ও ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি নয়ন খানের নেতৃত্বে আল-মদিনা রাইস মিল নামে একটি চালের মিলে হামলা হয়। তারা ক্যাশ বাক্স লুট করে এবং মিলমালিকের ছেলেসহ তিনজনকে পিটিয়ে যখম করে। পরে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরী করেন মিলমালিক। একইভাবে রাজধানীর মগবাজারে বাটার গলিতে অবস্থিত তৃপ্তি হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট নামে একটি রেস্তোরাঁয় চাঁদা তুলতে যায় মো. নয়নের নেতৃত্বে কয়েকজন বখাটে। ১৬ অক্টোবর রেস্তোরাঁর কর্মীরা তাদের গণপিটুনি দেন। সম্প্রতি ডিএমপির ক্যান্টনমেন্ট থাকা এলাকায় আরব আলী নামে এক ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবী করে শাহজাহান ওরফে সাবু, দুলাল প্যাদা ওরফে জিএমপি দুলাল ও সাইফুল ইসলাম ওরফে সুজনসহ কয়েকজন। আরব আলী সেখানে একটি একটি সুয়ারেজ ড্রেন নির্মানের ঠিকাদারী কাজ করছিলেন। চাঁদা না দেওয়ায় আরব আলীর বাসার সামনেই তার ডান পায়ে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দুটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে। এ বিষয়ে ডিবি প্রধান হাফিজ আক্তার জানান, ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে আসামীদের শনাক্ত করে পরে তাদের গ্রেফতার করা হয়। চক্রটি ভাসানটেক, কালশী, ক্যান্টনমেন্ট, মাটিকাটা এলাকায় চাঁদাবাজি করতো। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসারও অভিযোগ আছে।

চক্রটি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, শাহ আলী, বসিলা ও শ্যামলী এলাকায় বিভিন্ন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে একাধিক চক্র। এলাকার ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নির্মাণাধীন ভবন মালিক, দোকানদার, গার্মেন্টস মালিক কেউই এদের চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পাচ্ছিল না। ১১ অক্টোবর রাজধানীর ঢাকা উদ্যান এলাকায় চাঁদাবাজির প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তাদের গ্রেফতার করা হয়। চক্রের সদস্যরা হচ্ছে জহিরুল ইসলাম ওরফে জহির, জসিম উদ্দিন, জাহিদুল ইসলাম শিকদার, খায়রুল ভূঁইয়া, রাকিব হাসান ও মো. নয়ন।

এ ছাড়া রাজধানীর পল্টন থেকে চাঁদাবাজির সময় গতকাল গ্রেফতার করা হয় মেহেদী আলম ও যুবরাজ খানকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল। তারা পল্টন এলাকায় যুবলীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতো। র‌্যাব-৩ এর সহকারী পুলিশ সুপার ফারজানা হক জানান, পল্টন, মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও আশপাশের এলাকায় মেহেদীর নেতৃত্বে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। গ্রেফতার মেহেদী মিথিলা এন্টারপ্রাইজের নাম ব্যাবহার করে পল্টন মতিঝিল এলাকায় মোটরসাইকেল রাখার জন্য চাঁদা আদায় করত। বুধবার বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা তোলার সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী থানা এলাকা থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরা হচ্ছে সজীব হোসেন, মোহাম্মদ আবু রায়হান, মোহাম্মদ শিপন, আল আমিন, মুসলিম মিয়া ও মোহাম্মদ ইলিয়াস। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও অন্যান্য যানবাহন থেকে চাঁদা তুলতো।

এসব ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের নাম ব্যবহার করে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী সবজি ও মাছের আড়ত, কারওয়ান বাজার সবজির আড়তে বর্গফুট মেপে মেপে চাঁদা আদায় করা হয়। বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলে গুলিস্তান, মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট, সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথে। চাঁদা দিতে হয় রাজধানীর বনশ্রী, আফতাবনগর, রামপুরা, মুগদা, মান্ডা, মোহাম্মদপুর, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি নির্মানে। আবার স্থানীয় মাস্তানদের নির্দিষ্ট করা দোকান থেকে কিনতে হয় নির্মাণসামগ্রী। মিরপুর, রামপুরা, আশুলিয়া, টঙ্গী এলাকার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েও চলে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। রাজনৈতিক দল আশ্রিত মাস্তান বাহিনী ও এলাকার প্রভাবশালীদের ভয়ে অনেক সময় ভুক্তভোগীরা আইন প্রয়োগকারি সংস্থার কাছে অভিযোগ জানাতে অনীহা প্রকাশ করেন। 

সরকার দল বা অঙ্গ দলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগরী উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিই। কিছু অভিযোগে নাম-ঠিকানা সঠিক পাওয়া যায় না। তাই হয়তো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। ইউনিট নেতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে ওয়ার্ড নেতা, ওয়ার্ডের কোনো নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে থানার নেতা এবং থানা কমিটির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে মহানগর কমিটি ব্যবস্থা নিচ্ছে। চাঁদাবাজির বিষয়ে আমাদের অবস্থান বরাবরই জিরো টলারেন্স।’ ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের কোনো ইউনিটের কোনো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগের সত্যতা পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব। আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে কাউকে চাঁদাবাজি-মাস্তানী করতে দেয়া হবে না।’ নগরজুড়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নগরবাসীর দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন কর্মকান্ডে চাঁদা দেওয়া যেন একটা সংস্কৃতি বা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। নতুন জমি ক্রয়-বিক্রয়, ভবন নির্মাণ বা ফ্ল্যাট কিনতে গেলেও চাঁদা দিতে হচ্ছে। বিয়ের উৎসব বা পারিবারিক ঝামেলা মীমাংসা করতে গেলে চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদাবাজিকে আমরা সহজ করে দেখছি। এটা কিন্তু সহজ করে দেখার মতো বিষয় নয়। বরং সন্ত্রাসীরা নগরবাসীকে কোণঠাসা করে বা হুমকি-ধমকি দিয়ে চাঁদা নিচ্ছে। যারা এসব চাঁদা আদায় করছে তারা একই পাড়া বা মহল্লার লোক। তাদের কারও কারও রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। চাঁদাবাজরা নগারবাসীকে নানাভাবে শাসন ও শোষণ করছে। আধুনিক সময়ে চা বা নাশতা বা মিষ্টি খাওয়ার নাম করেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। বিপদ ও পরিস্থিতি ঘোলাটে যেন না হয় বা পরবর্তী সময়ে যাতে ঝামেলায় না পড়ে সে জন্য ভুক্তভোগীরা চাঁদা দিয়ে দিচ্ছে। দিন দিন এটা বেড়ে চলছে। এতে মানুষের প্রতি মানুষের সম্মান, বিশ্বাস বা বিবেকবোধ কমে যাচ্ছে। বিপদে কেউ কারও পাশে দাঁড়াচ্ছে না। পুলিশের কাছে অভিযোগ না দেওয়ায় চাঁদাবাজীর অনেক ঘটনা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নিলে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য কমে আসবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর