ইতিকাফের বিধান : ইতিকাফ গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত। একজন রোজাদার মাহে রমজানে নিজের দুনিয়াবি সব ব্যস্ততা ছেড়ে মসজিদে চলে আসেন একমাত্র আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। ৯-১০ দিন মসজিদে অবস্থান করেন। এই সংক্ষিপ্ত সময় সম্পূর্ণ মনোযোগ ও একাগ্রতার সঙ্গে আল্লাহর জিকির-আজকার দোয়া-দরুদসহ বহু ইবাদতে নিয়োজিত থাকেন। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিলের জন্য চেষ্টা ও সাধনা চালিয়ে যান। যতক্ষণ ইতিকাফকারী ইতেকাফে থাকেন, ততক্ষণ তার পানাহার, ওঠা-বসা, ঘুমানো জেগে থাকা ইত্যাদি সব ইবাদতের মধ্যে গণ্য হয়ে যায়। সুবহানআল্লাহ! মনে হয় ইতিকাফকারী আল্লাহর ঘরে এসে বলছেন, ওগো সকল জাহানের মালিক, আমি এসেছি, আমায় ক্ষমা করে দিন, যতক্ষণ আপনি আমাকে ক্ষমা না করবেন ততক্ষণ আমি আপনার দরবার ছাড়ব না। বুঝা গেল ইতিকাফ গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত। যা বিশেষ নিয়তে, বিশেষ অবস্থায়, আল্লাহতায়ালার আনুগত্যের উদ্দেশে মসজিদে অবস্থান করতে হয়। শবেকদরকে পাওয়া এবং এই পবিত্র রাতের ঘোষিত ফজিলত থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য ইতিকাফ থেকে উত্তম আর কিছু হতে পারে না। ইতিকাফ সম্পর্কে হজরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বর্ণনা করেন, ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। ওফাত পর্যন্ত তিনি এভাবেই (ইতিকাফ) করে গেছেন।’ (অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত ইতিকাফের এই ধারা অব্যাহত ছিল) (বুখারি ও মুসলিম) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. বর্ণনা করেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।’ হজরত নাফে বলেন, ‘আমাকে হজরত ইবনে ওমর রাযি. ওই স্থানটি দেখিয়েছেন যে স্থানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ করতেন।’ (মুসলিম শরিফ)
ইতিকাফের ফজিলত : হজরত ইবনে আব্বাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ইতিকাফকারী গোনাহ থেকে মুক্ত থাকে। তাঁর সব নেক আমল এমনভাবে লিপিবদ্ধ করতে থাকে, যেভাবে তিনি নিজে করতেন।’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত) অর্থাৎ ইতিকাফের বাহিরে থাকতে ইতিকাফকারী যেসব ভালো কাজ আনজাম দিতেন, যা তিনি ইতিকাফ থাকার কারণে করতে পারছেন না, সেসব আমল আগের মতোই লিপিবদ্ধ হতে থাকে। সুবহানআল্লাহ!
ইতিকাফের কয়েকটি জরুরি মাসআলা :
১. ইতিকাফের জন্য জরুরি হলো, মুসলমান হওয়া, আকেল ও বালিগ হওয়া এবং সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া। সুতরাং কাফের এবং মাতাল লোকের ইতিকাফ সঠিক হবে না। নাবালেগ তবে বুঝ হয়েছে- এমন বাচ্চা যেরূপ নামাজ, রোজা পালন করতে পারে, তেমনি ইতিকাফও পালন করতে পারে। (বাদায়েউস সানায়ে)
২. আমাদের মা-বোনরাও ঘরে কোনো স্থান নির্দিষ্ট করে ইতিকাফ করতে পারেন। তবে তার স্বামীর অনুমতি আবশ্যক। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হায়েজ ও নেফাস থেকে পাক-সাফ থাকতে হবে।
৩. পুরুষরা মসজিদে ইতিকাফ করবেন। ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, মসজিদে আকসা, এরপর পৃথিবীর যে কোনো জামে মসজিদ। জামে মসজিদে ইতিকাফ করা উত্তম। কারণ জুমার জন্য অন্যত্র যেতে হবে না। যেসব শরয়ী মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, সে মসজিদে ইতেকাফ করা যায়। (শামী ২/১২৯)
৪. ইতিকাফ তিন প্রকার :
১. রমজানের শেষ ১০ দশকের ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া অর্থাৎ মসজিদের মহল্লার কেউ না কেউ মসজিদে ইতিকাফ করতে হবে। যদি কোনো মুসল্লি ইতিকাফ না করেন তাহলে সবাই গুনাহগার হবেন। আর যদি কোনো একজন ইতিকাফ করেন তাহলে সব মুসল্লিরা এর গুনাহ হতে বেঁচে যাবেন। চাঁদের হিসাবে ২১ তারিখ রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতিকাফের সময়। কারণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক বছর এই দিনগুলোতেই ইতেকাফ করতেন।
২. ওয়াজিব ইতিকাফ : মান্নতের ইতিকাফ ওয়াজিব। সুন্নত ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে তা কাজা করা ওয়াজিব।
৩. নফল ইতেকাফ : এ ইতিকাফ মানুষ যে কোনো সময় করতে পারে। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ চায় করতে পারে। রোজারও প্রয়োজন নেই। এই তিন ধরনের ইতিকাফের ভিন্ন ভিন্ন মাসায়েল আছে।
৫. ইতিকাফের সবচেয়ে বড় রুকন হলো ইতিকাফের পুরো সময় মসজিদের সীমানায়ই অবস্থান করা। শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের সীমানা থেকে বাইরে না যাওয়া। শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের সীমানার বাইরে সামান্য সময়ও অবস্থান করলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়।
৬. রোজা ইতিকাফের জন্য পূর্বশর্ত।
৭. কোনো ইতিকাফকারী কোনো প্রয়োজনীয়তার কারণে বাইরে গেছেন, কিন্তু প্রয়োজন সেরে বাইরেই কিছুক্ষণ অবস্থান করলেন, তাতেও ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (শামী)
৮. ইতিকাফকারী যদি বেহুঁশ বা পাগল হয়ে যায়, জিন-ভূতের আছরের কারণে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে এবং এ অবস্থা যদি এক দিন এক রাত বিদ্যমান থাকে তবে ধারাবাহিকতা খতম হয়ে যাওয়ার কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। যদি এক দিন এক রাত পূর্ণ হওয়ার আগেই হুঁশ বা বুদ্ধি ফিরে আসে, তবে ইতিকাফ নষ্ট হবে না। (আলমগিরি) তবে ইতিকাফকারী যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, যার চিকিৎসা মসজিদের বাইরে যাওয়া ছাড়া সম্ভব নয় তবে তার জন্য ইতিকাফ ভেঙে দেওয়ার অনুমতি আছে। (শামী) বাইরে কোনো লোক ডুবে যাচ্ছে বা আগুনে দগ্ধ হচ্ছে তাকে বাঁচানোর আর কেউ নেই, অনুরূপ কোথাও আগুন লেগেছে, নেভানোর কেউ নেই তবে অন্যের প্রাণ বাঁচানোর এবং আগুন নেভানোর জন্য ইতিকাফকারীর ইতিকাফ ভেঙে দেওয়ার অনুমতি আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। সুন্নত ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর মসজিদের বাইরে চলে আসা জরুরি নয়। তবে ইচ্ছা করলে মসজিদের বাহিরে আসতেও পারবেন। বরং উচিত হলো বাকি দিনগুলো নফলের নিয়ত করে মসজিদের মধ্যে অবস্থান করা। এর দ্বারা সুন্নতে মুয়াক্কাদা তো আদায় হবে না কিন্তু নফল ইতিকাফের সওয়াব পাওয়া যাবে। মসজিদে অবস্থানের কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে সুন্নত ইতিকাফেরও সওয়াব দিয়ে দিতে পারেন। রব্বুল আলামিন ইতিকাফকারীদের সঠিক নিয়মে ইতিকাফ করার তাওফিক দান করুন। আমিন ইয়া রাব্বাল আলামিন।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        