বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ধরাছোঁয়ার বাইরে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি

শাহেদ আলী ইরশাদ

ধরাছোঁয়ার বাইরে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি

ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি। এসব খেলাপের বেশির ভাগ ইচ্ছাকৃত এবং অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। ঋণখেলাপি এসব রাঘববোয়াল এতই প্রভাবশালী যে, আইনি ব্যবস্থা নিয়েও তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাকা আদায়ে প্রয়োজনে এসব খেলাপির সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে যে আমানত রাখছেন, তার একটা অংশ নিয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। তা ফেরতও দিচ্ছেন না। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা ব্যাংক খাতের জন্য একটা বড় সমস্যা। তারা বলছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে আরও কঠোর হতে হবে। দু-এক জন ঋণখেলাপির শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ হিসাবে গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ গ্রহীতার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। সরকারের হিসাবে শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় রয়েছে সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি, খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৫২৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। রিমেক্স ফুটওয়্যারের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। রাইজিং স্টিল কোম্পানির খেলাপি ৯৯০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্সের খেলাপি ৯৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যারের খেলাপি ৮৭৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ক্রিসেন্ট লেদারসের খেলাপি ৮৫৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেমসের খেলাপি ঋণ ৮১১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। সাদ মুসা ফেব্রিকসের খেলাপি ঋণ ৭৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। বিআর স্পিনিং মিলসের খেলাপি ঋণ ৭২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এস এ অয়েল রিফাইনারির খেলাপি ঋণ ৭০৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। মাইশা প্রোপ্রার্টি ডেভেলপমেন্টের খেলাপি ঋণ ৬৬৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইলের খেলাপি ঋণ ৬৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। সামান্নাজ সুপার অয়েলের খেলাপি ঋণ ৬৫১ কোটি ৭ লাখ টাকা। মানহা প্রিকাস্ট টেকনোলজির খেলাপি ঋণ ৬৪৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আশিয়ান এডুকেশনের খেলাপি ঋণ ৬৩৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এস এম স্টিল রি-রোলিং মিলসের খেলাপি ঋণ ৬৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্সের খেলাপি ঋণ ৬২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এহসান স্টিল রি-রোলিংয়ের খেলাপি ঋণ ৫৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সিদ্দিকী ট্রেডার্সের খেলাপি ঋণ ৫৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, সাধারণ মানুষ ব্যাংকে যে আমানত রাখছেন, তার একটা অংশ নিয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। তা ফেরতও দিচ্ছেন না। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা ব্যাংক খাতে একটা বড় সমস্যা। ওই অনুষ্ঠানে আরেক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খেলাপি ঋণ কমবে না। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বললেও কমবে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছর খেলাপি ঋণ আদায়ে নানা রকম ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে দেশের ব্যাংক খাতে গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমেছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে খেলাপি ঋণ আরও আদায় হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সার্বক্ষণিক নানা রকম দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খেলাপি ঋণের অধিকাংশই ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কাছে। সুতরাং এসব ইচ্ছাকৃত খেলাপি স্বেচ্ছায় ব্যাংকের টাকা ফেরত দেবেন না। তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। বিচার বিভাগকে শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে; যাতে অন্যরা তা দেখে ঋণের টাকা ফেরত দেন। টাকা আদায়ে প্রয়োজনে এসব খেলাপির সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। সবশেষ হিসাবে দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ ৪ দশমিক ৯১। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রায় ১৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, দেশের ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা’ তাদের অর্থশক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করে বছরের পর বছর মামলাগুলো ঝুলিয়ে রাখতে সমর্থ হচ্ছেন। এই খেলাপি ঋণের বৃহদাংশ তারা দেশের বাইরে পাচার করেন। তারা বিদেশে ঘরবাড়ি কিনে, ব্যবসাপাতি করে বহাল তবিয়তে সপরিবার দিনাতিপাত করছেন। আমাদের বিচারব্যবস্থার নানা সমস্যা ও দীর্ঘসূত্রতা বিবেচনায় নিয়ে এখন প্রয়োজন সব ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন।

 

সর্বশেষ খবর