শনিবার, ২০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর এলএসডি

আলী আজম

ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর এলএসডি

লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড বা এলএসডি। এটি সেবনের পর রক্তচাপ বেড়ে যায়, দেহের তাপমাত্রাও বাড়ে, দৃষ্টি বিভ্রম বা হেলুসিনেশন হতে পারে। তখন নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন একজন মানুষ যা খুশি তাই করতে পারেন। এমনকি উঁচু ভবন থেকে লাফ দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। ২০১৯ সালে এই মাদকটি বাংলাদেশে ধরা পড়লেও খুব একটা আলোচনায় আসেনি। ২০২১ সালের ১৫ মে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর এই মাদকটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। সর্বশেষ এলএসডিসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন- একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারদিন খান, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) মফিজুর রহমানের শ্যালক ইব্রাহিম কিবরিয়া ও জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদের ছেলে আযরাফ আহমেদ ওজি। ভয়ংকর এই মাদকটি ক্রমেই ধনাঢ্য পরিবারের তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশি সম্পৃক্ততা পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দাম বেশি হওয়ায় এটি রুট পর্যায়ে এখনো ছড়িয়ে পড়েনি। জানা গেছে, এলএসডির ভয়াবহতা বিবেচনায় ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এটাকে নিষিদ্ধ মাদকের তালিকায় রাখা হয়। জাতিসংঘও ১৯৭১ সালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এলএসডি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ধনাঢ্য ঘরের সন্তানরা এই মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। যদি দেশের বাজারে এলএসডির চালান বাড়তে থাকে তাহলে দাম কমে সব শ্রেণির মাদকাসক্তদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ধরনের মাদক নির্মূলে চাহিদা হ্রাস করতে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। গত ৮ মে নেদারল্যান্ডসের রাজধানীর আমস্টারডাম থেকে ডাকযোগে একটি সন্দেহজনক পার্সেল ঢাকায় আসে। প্রাপকের নামের ঠিকানা ছিল ফারদিন খান। ঠিকানা দক্ষিণ বাড্ডা, কাঁচাবাজার। তবে পার্সেলটি কেউ নিচ্ছিল না, এরপর ডাক বিভাগ বিষয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে (ডিএনসি) জানায়। ডিএনসির গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পরিচালক রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে একটি টিম গিয়ে পার্সেলটি খোলেন। পার্সেল খুলে ২৫টি এলএসডি ব্লটার পায় কর্মকর্তারা। কর্মকর্তারা মাদক চোরাকারবারিদের ধরতে পার্সেলটি নিয়ে অপেক্ষা করেন। তারা গুলশান পোস্ট অফিসের আশপাশে অপেক্ষায় থাকেন। ১৫ মে পার্সেল নিতে আসেন আযরাফ আহমেদ ওজি। ডিএনসির কর্মকর্তারা তাকে আটক করেন। তখন তিনি নিজেকে জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদের ছেলে বলে পরিচয় দেন। তিনি জানান, যার নামে পার্সেলটি এসেছে সেই ফারদিন খান তার বন্ধু। ফারদিনই পার্সেলের মালিক। তাকে এটি নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। এরপর ওজিকে দিয়ে ফারদিনকে আটক করা হয়। তাকে আটকের পর ইব্রাহিম নামে এক যুবকের তথ্য পান। তাকে ধরতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে যান ডিএনসি কর্মকর্তারা। পরে তাকে আটক করা হয়। তখন তিনি নিজেকে শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস মফিজুরের শ্যালক বলে পরিচয় দেন।

মফিজুর রহমানের শেরেবাংলা নগরের সরকারি বাসায়ই থাকেন ইব্রাহিম। মফিজুরের ফ্ল্যাটেও তল্লাশি অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকেও এমডিএমএ (মেথাইলিন ডক্সি মেথা এমফিটামিন) উদ্ধার করা হয়। এ সময় এপিএস মফিজুর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই দিনই ফারদিন, ইব্রাহিম ও ওজিকে নিয়ে সেগুনবাগিচায় ডিএনসি সদর দফতরে আনা হয়। ১৫ মে রাতে তাদের কার্যালয় রাখা হয়। ১৬ মে ওজি ও ইব্রাহিমকে ছেড়ে দিতে ডিএনসিতে প্রভাবশালী থেকে চাপ আসতে শুরু করে। ছাড়িয়ে নিতে শাফিন আহমেদ ও এপিএস মফিজুর রহমান ডিএনসি সদর দফতরে আসেন।

পরে চাপের মুখে পড়ে ডিএনসি কর্তৃপক্ষ ইব্রাহিম ও ওজির কাছ থেকে ১০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার হয়েছে বলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবা হকের ভ্রাম্যমাণ আদালতে একদিন করে সাজা দেওয়া হয়। যেহেতু তারা একরাত ডিএনসিতে ছিলেন, তাই ১৬ মে তাদের পরিবার সাজা শেষে নিয়ে যান। ইব্রাহিমের দুলাভাই মফিজুর রহমান এবং ওজির বাবা শাফিন আহমেদের কাছ থেকে সাদা কাগজে মুচলেকা নেওয়া হয়। এতে তারা লেখেন, সংশ্লিষ্টরা আর কখনো মাদকসেবন করবেন না। তাদের মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে কোনো তদবির না থাকায় ফারদিনের বিরুদ্ধে ১৬ মে পল্টন থানায় ডিএনসির পরিদর্শক মাসুদুর রহমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। মামলায় একমাত্র ওই মামলার আসামি। সেখানে ইব্রাহিম ও ওজি কাউকে আসামি করা হয়নি। সে মামলায় ফারদিন এখন কারাগারে। দুজনকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস্ ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ সাংবাদিকদের বলেন, যার কাছে মাদক পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ডিএনসির এক কর্মকর্তা বলছেন, শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস মফিজুরের শ্যালক ইব্রাহিম তার সঙ্গেই শেরেবাংলা নগরের সরকারি বাসায় থাকেন। সেখানে বসেই বন্ধু ওজি ও ফারদিনের মাধ্যমে এলএসডি মাদক কেনাবেচার চক্র নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা তিনজনই এলএসডিতে আসক্ত। এলএসডি কৃত্রিম মাদক, যা পরীক্ষাগারে তৈরি। মাদকটি দেশে অপ্রচলিত এবং খুবই ভয়ংকর। এই মাদকের উৎস ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। এ ধরনের মাদক মনের ওপর প্রভাব ফেলে, কখনো কখনো ভীতিকর অনুভূতি তৈরি করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তখন সে যা খুশি তাই করে ফেলে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা বলছেন, সব মাদকই ক্ষতিকর। কিন্তু এলএসডির সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এটা সেবনের ফলে দৃষ্টি বিভ্রম বা হেলুসিনেশন হয়ে থাকে। এখন কেউ যদি খুব খুশিতে থেকে এই ড্রাগ নেয় তাহলে তার মধ্যে রঙিন চিন্তা আসে। আর কেউ যদি খারাপ অবস্থার মধ্যে থেকে এই ড্রাগ নেয় তাহলে খারাপ জিনিসগুলো তাকে ভর করে। সে তখন যা খুশি তাই করতে পারে। এমনকি আত্মহত্যাও করে ফেলতে পারে, উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়তে পারে। ফলে এটা সরবরাহের রুটটা আগে বন্ধ করতে হবে। এটা অন্য মাদকের চেয়ে দামি। যারা নিয়মিত মাদক সেবন করে তারা সব সময়ই নতুন নতুন মাদক খোঁজেন। এই মাদকের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশি সম্পৃক্ততা দেখছি আমরা। এটি কোনোভাবেই যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খেয়াল করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, বর্তমান সময়ের আধুনিক বা ক্ষতিকর মাদক বলতে আমরা যা বুঝি তার মধ্যে এলএসডি অন্যতম। এই মাদক গ্রহণ করে তরুণদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। নিজেই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। এই মাদক গ্রহণের ফলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যিনি গ্রহণ করেন তাকে দিয়ে যে কোনো ধরনের কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব। যারা ইতোমধ্যে এটি গ্রহণ করেছে তারা ভয়ংকর পরিণতির দিকে ধাবিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এলএসডি মাদক সস্তা মাদক নয়, এটি বেশ চড়া দাম দিয়ে কিনতে হয়। সমাজের বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা এই মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। দেশের সীমান্ত, লাগেজ বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক আসছে। মাদক উদ্ধার, গ্রেফতার ও মামলা হচ্ছে কিন্তু মাদক নিয়ন্ত্রণে আসছে না। মাদকের বিরুদ্ধে এক সময় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তিরা সোচ্চার ছিল, সেই জায়গাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। এখনই এলএসডিসহ মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দমন করতে হবে, নইলে আমাদের জন্য ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে। ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্ল্যাহ কাজল বলেন, ভয়ংকর মাদক এলএসডি ডাকযোগে আসছে। ক্রিপটোকারেন্সি ব্যবহার করে ডার্ক ওয়েবে যোগাযোগ করেও আনা হচ্ছে এলএসডি। এটি সহজলভ্য নয়, ফলে এটি এখনো রুটপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েনি। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মধ্যে এই মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেশি। আমরা এই মাদক ধরতে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছি। অভিযানে এলএসডি উদ্ধারসহ আসামি ধরা পড়ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর