টেকনাফের পুরান পল্লানপাড়া পাহাড়। এ ছাড়া বাহারছড়া, জাহাজপুরা, হ্নীলা, রঙ্গীখালী ও হোয়াইক্যং এলাকায় রয়েছে ছোটবড় অসংখ্য পাহাড়। সবুজ শান্ত স্নিগ্ধ মনে হলেও শান্তি নেই এ জনপদে। আছে ভয় আর আতঙ্ক। পাহাড়ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য গ্রাম। গ্রামগুলোর মানুষ দিনের আলোয় চলাচল করলেও রাতে সবাই থাকে একসঙ্গে। কারণ পাহাড়ে আছে সশস্ত্র ১০ গ্রুপ। যারা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। মুক্তিপণ আদায় করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা মুক্তিপণ দিতে পারছে না, তাদের হত্যা করে ফেলে রাখা হচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশে। কারও লাশ কখনই খুঁজে পাওয়া যায় না। গত ছয় মাসে এভাবেই ৬২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন; যার অধিকাংশই মুক্তিপণের টাকা দিয়ে নিজগৃহে ফিরেছেন। রোহিঙ্গা এসব দুর্বৃত্তের কারণে নৈসর্গিক সুন্দর টেকনাফের সবুজ পাহাড়গুলো এখন ভয়ংকর। এ পাহাড়গুলো এখন অপহরণ বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সরেজমিনে জানা গেছে, টেকনাফের পুরান পল্লানপাড়া পাহাড়ের কয়েক হাজার একর জমি দখল করে রামরাজত্ব কায়েম করেছে হাকিম ডাকাত গ্রুপ। ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা সে করে না। হাকিম ডাকাতের রয়েছে নিজস্ব অস্ত্রধারী চৌকশ ফোর্স। সৃষ্টি করেছে নিজস্ব বাহিনী, ট্যাক্স আদায়কারী ও সমন্বয়ক। পাহাড়ের এই রাজার কাছে অনেকটা ‘অসহায়’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার কারণে এলাকাছাড়া হয়েছে শত শত পরিবার। ঝরেছে অনেক তাজা প্রাণ। গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানান, পাহাড়গুলোয় ১০টি দুর্বৃত্ত দল বর্তমানে সক্রিয়। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাসহ তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং সাতটি ডাকাত দল সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ পাহাড়ের ওপর রয়েছে আরসার নিয়ন্ত্রণ। পল্লানপাড়ার পাহাড় আরসার সাংগঠনিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ে সক্রিয় আরসা, আরএসও এবং মাস্টার মুন্না দল; এ ছাড়া আছে ইসলামী মাহাজ, জাবু ডাকাত দল, চাকমা ডাকাত দল, নবী হোসেন ডাকাত দল, পুতিয়া ডাকাত দল, সালমান শাহ ডাকাত দল, খালেক ডাকাত দল। কক্সবাজারের সীমান্ত জনপদ টেকনাফে গত ছয় মাসে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে অন্তত ৬২ জনকে। টেকনাফের তিনটি ইউনিয়ন হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় মূলত এসব অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এসব এলাকায় গত এক বছরে মাদকের চালান জব্দের ঘটনা কয়েক গুণ বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মতে, ইয়াবা ও আইস (ক্রিস্টাল মেথ) মাদক পাচারের ঘটনা বাড়ার সঙ্গে এসব অপহরণের যোগাযোগ রয়েছে। একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী এসব অপহরণের সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশসূত্রে জানা গেছে। পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিপণ আদায়ে অপহরণের জন্য সন্ত্রাসীদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু ইয়াবা কারবারি অথবা তাদের আত্মীয়স্বজন। এর পাশাপাশি এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরা অপহরণের শিকার হয়েছেন। টেকনাফের এসব অপহরণের ঘটনায় যে ইয়াবার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তা স্বীকার করেছেন। কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ এবং ইয়াবা কারবারিদের আইনের আওতায় আনা গেলে অপহরণসহ নানা অপরাধ বন্ধ হবে।
আতঙ্কে সাধারণ মানুষ : টেকনাফের কলেজশিক্ষক ও হ্নীলার বাসিন্দারা বলেন, ইয়াবা কারবারিদের ধরে নিতে পারলে মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে কে ইয়াবা ব্যবসা করে, তাদের অবস্থান জানা থাকে সন্ত্রাসীদের। মাঝেমধ্যে ভুল তথ্যে সাধারণ ও গরিব কৃষককে অপহরণ করা হয়। এই কলেজশিক্ষকের মতে, ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হলে সামাজিক অস্থিরতা ও অপহরণের মতো অপরাধও বন্ধ হবে। হ্নীলা ইউনিয়নের মানুষজনের কাছে অপহরণ এখন বড় আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ওই ইউনিয়নে সাত কিশোর অপহরণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ এপ্রিল দুপুরে হ্নীলার জাদিমোরার নেচার পার্ক এলাকা থেকে পাঁচ রোহিঙ্গা কিশোর অপহৃত হয়। এরা সবাই হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা। জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে এসব কিশোরকে মুক্ত করে আনা হয়েছে বলে তাদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। এর আগে ২৬ মার্চ নেচার পার্ক এলাকা থেকে অপহৃত হয়েছিল হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া এলাকার দুই কিশোর। এক দিন পর সন্ত্রাসীদের ৪ লাখ টাকা দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয় তাদের। কিন্তু অপহরণের এ দুই ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ছয় মাসে মুক্তিপণের জন্য তিন ইউনিয়নের ৫৭ স্থানীয় বাসিন্দা ও পাঁচ রোহিঙ্গা কিশোর অপহরণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৩৯ জন থেকে আদায় হয়েছে অর্ধকোটি টাকার মুক্তিপণ। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল হালিম বলেন, অধিকাংশ অপহরণের ঘটনা মাদক ঘিরে হচ্ছে। যারা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসছেন, তাদের কেউ থানায় অভিযোগ করছেন না। তাদের অনেকের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী এসব অপহরণের সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোকও জড়িত। টেকনাফ থানার তথ্যমতে, ২০২২ সালের ১ নভেম্বর থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে টেকনাফ থানায় অপহরণের মামলা হয়েছে সাতটি। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৪৬। এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ১৩ জনকে। একই সময়ে অপহৃত ২৩ জনকে উদ্ধার করে পুলিশ। অবশিষ্ট ৩৯ জন নিজ উদ্যোগে বাড়ি ফেরেন।