♦ বিপিসি ও বিপণন কোম্পানি, তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি, পেট্রলপাম্পের মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী জ্বালানি তেলে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত
♦ ভেজাল তেলে অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি, চর্মরোগ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি
♦ মুনাফার লোভে অপরিশোধিত কনডেনসেট সরাসরি অকটেন বা পেট্রলের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি, পেট্রলে মেশানো হচ্ছে পানিধানমন্ডির স্যানেটারি ব্যবসায়ী ইউসুফ উদ্দিন নিজের প্রিমিও গাড়িটি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। গত সপ্তাহে গাড়িতে হঠাৎ যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ছুটে যান দীর্ঘদিনের পরিচিত মেকারের কাছে। সব দেখেশুনে মেকার ইউসুফউদ্দিনকে জানান, গাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে অসাবধানতাবশত ভেজাল জ্বালানি তেল ব্যবহারের কারণে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকার একটি ফিলিং স্টেশন থেকে নিয়মিত তেল নিতেন। ইউসুফ উদ্দিনের মতোই আরও অনেক গাড়ির মালিক ইঞ্জিনে সমস্যা নিয়ে গ্যারেজে যাচ্ছেন। এদের বেশির ভাগেরই সমস্যা কমবেশি এক। রাজধানীর বেশ কয়েকটি গ্যারেজে সম্প্রতি মেকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভেজাল তেল ব্যবহার করার জন্য প্রায়ই গাড়ির মালিকরা গাড়িতে ত্রুটি নিয়ে তাদের কাছে আসছেন। মেকাররা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গাড়ির ইঞ্জিনে ভেজাল তেল ঢুকলে বিকট শব্দ হয়। এতে গাড়ি ঠিকমতো চলে না। এরপর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ির তেলের ট্যাঙ্ক ও ইঞ্জিনের ভিতর থেকে সব তেল বের করে ফিল্টার বদল করে আবার নতুন তেল ভরার পরই গাড়িটি ঠিক হয়। সাধারণত ভেজালের মাত্রা কম হলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় না। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ইঞ্জিনের ক্ষতি হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের পেট্রলপাম্পগুলোতে একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি তেলে ভেজাল মিশিয়ে আসছে। মাঝে তেলে ভেজাল দেওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমলেও মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এ চক্র আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে জ্বালানি তেলে ভেজাল দেওয়ার পরিমাণ বেশি। রাজধানীর বাইরের ফিলিং স্টেশনে পেট্রলের সঙ্গে পানি মিশিয়েও বিক্রি করার অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে অপরাধও প্রমাণিত হয়েছে। গত বছর আগস্টে নাটোরের লালপুরে পেট্রলের সঙ্গে পানি মিশিয়ে বিক্রির অপরাধে গোপালপুরের মেসার্স সততা ফিলিং স্টেশনের মালিককে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৪৮ হাজার টাকা জরিমানা করেন। বিএসটিআই ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ৬৬০টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে ৯৬৩টি পাম্প বিএসটিআইর বেঁধে দেওয়া মানের তেল বিক্রি করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলে ভেজাল মেশানোর মতো অপরাধ এখনই বন্ধ করা উচিত। তা না হলে একদিকে যেমন গাড়ির ইঞ্জিন ও সেচের ইঞ্জিন নষ্ট হবে, অন্যদিকে এসব যন্ত্রপাতি মেরামত করতে গিয়ে খরচ বৃদ্ধি পাবে। আবার ভেজাল তেলে পরিবেশদূষণের পাশাপাশি বায়ুদূষণ থেকে নানা রকম রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়বে। ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভেজাল তেলের কারণে গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যে কালো ধোঁয়া বের হয় তা থেকে বায়ুদূষণ বেশি হয়। এ কারণে ফুসফুসজনিত রোগ বেশি হয়। অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানিও বেশি হয়। এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকিও বেশি থাকে। এ ছাড়া সাইনোসাইটিস, টনসিলাইটিস হতে পারে। অ্যালার্জিসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগের ঝুঁকিও তৈরি হয়। আর এ সমস্যার জন্য শিশু. বয়স্ক ও গর্ভবতী নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। জ্বালানি তেলে ভেজাল করা হলে ধরন অনুযায়ী দি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট, ১৯৩৪-এর ধারা ২৩(১) এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর ধারা ৪১ অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড, জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান । কিন্তু এ শাস্তির প্রয়োগ তেমন একটা ঘটেনি। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে কি না তা তদারক করে বিএসটিআই ও বিপিসি। এর মান পর্যবেক্ষণে আমাদের সক্ষমতা নেই। আমরা কোনো অভিযোগ পেলে এর ভিত্তিতে পেট্রলপাম্পে অভিযান চালাই। অভিযোগ পেলে আমরা হয়তো নমুনা সংগ্রহ করে তা বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় পরীক্ষা করাতে পারি।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভেজাল তেলের মধ্যে যদি নিষিদ্ধ সিসা থাকে আর এটি যদি বাতাসের সঙ্গে মিশে যায় তাহলে খুবই বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পরিবেশদূষণ রোধ করতে গাড়ির ইঞ্জিনের অবস্থা অবশ্যই ভালো হতে হবে। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দৈনিক ৮ হাজার ৫৪০ ব্যারেল কনডেনসেট উঠছে। এটি গ্যাসের সঙ্গে ওঠা উপজাত, যা পরিশোধন করে পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। কনডেনসেট প্রক্রিয়া করলে ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন, এলপিজিসহ সব ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখন, যখন বাড়তি মুনাফার লোভে অপরিশোধিত কনডেনসেটই সরাসরি অকটেন বা পেট্রলের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। এ ধরনের জ্বালানি দ্রুত বিকল করে দেয় গাড়ির মূল্যবান ইঞ্জিন। এ বিষয়ে নজরদারির ঘাটতি রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যেসব ঘাট থেকে তেল পরিবহন করে পেট্রলপাম্পে নেওয়া হয় সেখানেই বেশি ভেজাল মেশানো হয়। এ ছাড়া কনডেনসেট বেসরকারি পরিশোধনাগারে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানেও ভেজাল মেশানো হতে পারে। এই পুরো প্রক্রিয়াতে সরকারি-বেসরকারি একটি নেটওয়ার্ক সক্রিয়। দেশের বেসরকারি পরিশোধনাগারের কাছে যে কনডেনসেট বিক্রি হয়, তার অনুমোদন দেয় জ্বালানি বিভাগ। অনুমোদনের ভিত্তিতে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি আশুগঞ্জের কনডেনসেট হ্যান্ডলিং পয়েন্ট থেকে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু কনডেনসেট আনলোডিং পয়েন্টে পেট্রোবাংলা ও আরপিজিসিএল কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মনিটরিং থাকা জরুরি। না হলে ভেজালের মতো অনেক কিছুই ঘটতে পারে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় জ্বালানি তেল বিক্রির যে ডিপো রয়েছে সেগুলোকে কেন্দ্র করে ভেজাল তেল বিক্রির সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবহৃত জ্বালানি তেল কম দামে কিনে এনে ভেজাল সিন্ডিকেট ভালো তেলের সঙ্গে মিশিয়ে বিভিন্ন পেট্রলপাম্পে বিক্রি করছে। পেট্রলপাম্পগুলো সেই তেল আবার গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছে। অথচ দেশে মানসম্পন্ন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা বাধ্যতামূলক। এ জন্য বাজারজাত করার আগেই পেট্রল, অকটেন ও ডিজেলের মান পরীক্ষা করে সনদ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কখনোই জ্বালানি তেলের মান পরীক্ষা করায়নি এবং সনদ নেয়নি। এর ফলে উৎপাদন, পরিশোধন থেকে শুরু করে পেট্রলপাম্পে বিক্রি পর্যন্ত নানা পর্যায়ে জ্বালানি তেলে ভেজাল মেশানোর ঘটনা ঘটছে। ধারণা করা হচ্ছে বিপিসি, সরকারি বিপণন কোম্পানি, তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি ও পেট্রলপাম্পের মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশ নানা পর্যায়ে তেলে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে তেলে ভেজাল আছে কি না তা দেখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। আর অভিযানগুলোতে মানহীন তেল বিক্রির সঙ্গে ওজনে কম তেল দেওয়ার মতো ঘটনার প্রমাণ মেলে। বেসরকারি রিফাইনারি মালিক, ট্যাঙ্ক-লরি মালিক, শ্রমিক সংগঠন ও ফিলিং স্টেশন মালিকসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার জ্বালানি তেলের ভেজাল বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। মূলত বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিপো পর্যায়ে বেশি দামের তেলের সঙ্গে কম দামের তেলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এই গোঁজামিল দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নির্দিষ্ট কিছু ফিলিং স্টেশন অপরিশোধিত অর্থাৎ ভেজাল তেল কিনে থাকে। বিপিসির তিন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজারজাত তেলের চেয়ে দাম অনেক কম হওয়ায় এই ফিলিং স্টেশনগুলো সুযোগ লুফে নেয়। আবার বিপিসির পরিবর্তে ফিলিং স্টেশনগুলোতে বিক্রি করলে কয়েক গুণ বেশি লাভ পাওয়া যায়। এ কারণে বেসরকারি রিফাইনারিগুলো চুক্তি ভঙ্গ করে ‘ব্ল্যাক মার্কেটে’ তেল বিক্রি করে দেয়। ভেজাল তেলের জোগান বন্ধে বিপিসি প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে ফিলিং স্টেশনগুলোতে অভিযান চালায়। অভিযোগের সত্যতা মেলায় বিভিণ্ন সময় বেশ কিছু ফিলিং স্টেশন বন্ধ করে দেয় বিপিসি। বিএসটিআইর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হাসিব সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের অভিযানগুলোতে তাৎক্ষণিকভাবে তেলে ভেজাল আছে কি না তা পরীক্ষা করা ছাড়া বলার উপায় নেই। আমাদের কাছে যদি কোনো অভিযোগ আসে এর ভিত্তিতে বিএসটিআইর কর্মকর্তারা সে জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে বলতে পারবেন সেই তেলে ভেজাল আছে কি না।