বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্যভুক্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের ২ হাজার ৮৯টি কারখানার মধ্যে ৩০৭টিতে অক্টোবরের বেতন দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের বেতন এখনো দেয়নি ৭টি কারখানা। এসব কারখানার মধ্যে সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর ও মিরপুরের শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন। ফলে গার্মেন্ট খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনে যান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। গার্মেন্ট মালিকদের অভিযোগ, জুলাইয়ের আন্দোলনে কিছু কারখানা পিছিয়ে পড়েছে, তারা টাকা দিতে পারছে না। আবার কিছু গার্মেন্টের টাকা থাকলেও ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। যার ফলে শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। এক কারখানায় আন্দোলন শুরু হলে অন্যটি শ্রমিকদের জোর করে আন্দোলনে নিয়ে আসছে। ফলে এ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
বিজিএমইএর গত বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরের বেতন দিয়েছে ১ হাজার ৭৮২টি প্রতিষ্ঠান যা মোট সদস্যের ৮৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। বেতন দেয়নি ৩০৭টি কারখানা। যা ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। বেতন না দেওয়ায় গত বৃহস্পতিবার আশুলিয়া এলাকায় সাদাতিয়া সোয়েটার কারখানায় ১৩/১ ধারায় বন্ধ বা স্ব বেতনে শ্রমিকরা চলে গেছেন। সাভার এলাকায় গ্লোবাল এটায়ার লিমিটেড কারখানায় ১৩/১ ধারায় বন্ধ বা স্ব বেতনে শ্রমিকরা চলে গেছেন। কাশিমপুর এবং জিরানী এলাকায় বেক্সিমকোর শ্রমিকদের বেতনের দাবিতে কাজ বন্ধ করে বিভিন্ন কারখানায় হামলা করছে। এসব এলাকার ডোরেন গার্মেন্টস ও ডোরেন অ্যাপারেল ১৩/১ ধারায় বন্ধ। কোনাবাড়ী এলাকার স্বাধীন গার্মেন্ট কারখানা অক্টোবরের বেতনের দাবিতে বন্ধ। ভোগরা বাইপাইল গাজীপুর এলাকায় বেতনের দাবিতে বন্ধ রয়েছে টি এন জে, বেসিক ক্লোথিং, বেসিক নিটওয়্যার, তারাটেক্স ও অ্যাপারেল প্লাস। এ ছাড়া শ্রীপুর এলাকায় অ্যাপারেল ২১ লিমিটেড কারখানা ১৩/১ ধারায় বন্ধ। অর্থাৎ গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ এলাকার ৮৭০টি কারখানার মধ্যে বন্ধ রয়েছে ১০টি। সাভার আশুলিয়া এবং জিরানী এলাকার ৪০১টি কারখানার মধ্যে বন্ধ রয়েছে দুটি কারখানা। বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গার্মেন্টে দু-এক জায়গায় বেতনের সমস্যার কারণে অন্য ৮/১০টি কারখানার ক্ষতি হচ্ছে। গার্মেন্টে মালিকের টাকা থাকলেও অনেক ব্যাংক সময়মতো তা দিতে পারছে না। এটাও একটা সমস্যা যার ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শ্রমিকরা সময়মতো বেতন পাচ্ছে না। এ সমস্যা তো শ্রমিক বুঝতে চায় না। একই সঙ্গে দুয়েকটা কারখানা বেতন দিতে দেরি করছে। এত বড় একটা খাতে দু-একটায় সমস্যা থাকতেই পারে। তবে সমস্যাগুলো ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। জুলাই আন্দোলনে ঠিকমতো রপ্তানি করা ও কারখানা চালু রাখা যায়নি। ফলে কেউ কেউ সমস্যায় পড়েছে। সেজন্য একটু দেরি হতে পারে। যাতে দেরি না হয় এ জন্য সরকার ও বিজিএমইএ আন্তরিক। সরকার এসব সমস্যা সমাধানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋণ ও নগদ টাকা দিচ্ছে। বর্তমানে শ্রমিক আন্দোলন জাতীয় সমস্যা। এক্ষেত্রে তাদের বুঝানোর জন্য শ্রমিক সংগঠনেরও দায়িত্ব রয়েছে। তবে এ সমস্যা তো ৫০ বা ১০০ কারখানায় হয় না। ২ বা ৪টা কারখানায় বিশৃঙ্খলা হয়। এসব সমস্যা তাদের মধ্যে রাখলেই ভালো। তাদের অভ্যন্তরীণ এ সমস্যা নিয়ে তারা রাস্তায় নেমে আরও কয়েকটা কারখানার শ্রমিকদের নামতে বাধ্য করছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। কারও ইন্ধনে যদি অন্য কারখানা যেখানে সমস্যা নেই, সেখানে শ্রমিকদের বের করলে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকে। এ ছাড়া রাস্তা বন্ধ করে ভোগান্তিতে ফেলছে হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে।
পরিস্থিতি শান্ত করতে সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএ কর্মকর্তারা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার গাজীপুরের শ্রীপুরে বকেয়া বেতন দাবি ও পূর্ব নোটিস ছাড়াই কারখানা বন্ধের প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছে এইচডিএফ অ্যাপারেলস লিমিটেডের শ্রমিকরা। এ সময় তারা জৈনা বাজার-কাওরাইদ আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এইচডিএফ অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকরা জানান, অক্টোবরসহ দুই মাসের বেতন পাওনা আছে তাদের। দেই দিচ্ছি করে ঘুরিয়ে বৃহস্পতিবার হঠাৎ কারখানার গেটে তালা লাগিয়ে পালিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা কর্মস্থলে এসে দেখেন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নোটিস ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গাজীপুর মহানগরীর মোগরখাল এলাকার টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের ৫টি কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে প্রায় ৬০ ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এতে চরম জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত রাস্তায় দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। এ সময় তারা কয়েকটি কারখানা ভাঙচুর করে। এর জেরে ওই গ্রুপের পাঁচটিসহ আশপাশের অন্তত ৪৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। পরে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা হলে তারা অবরোধ প্রত্যাহার করে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এরপর অন্য কারখানাগুলো চালু হলেও টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডের বন্ধ হওয়া কারখানাগুলো এখনও চালু হয়নি। বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চলমান গার্মেন্ট অস্থিরতার বড় কারণ হলো স্থানীয় লোকজন তাদের প্রভাব বিস্তারে শ্রমিকদের নানা ধরনের উস্কানি দিচ্ছে। এসব কারণে একটা বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। চন্দ্রার দিকে একটা কারখানায় ঝামেলা হয়েছে সেখানে ২০টা সংগঠন গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। পরে ২০ সংগঠনকেই টাকা দিতে হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় দুরবস্থা। আগে যেমন ব্যাংক থেকে কারখানা সার্পোট পেত এখন সে ধরনের সুযোগ নেই। ফলে অনেক কারখানা তাদের বেতন-ভাতা সময়মতো দিতে পারছে না। এটা বাইরের সুবিধাভোগী লোকজন শ্রমিকদের উস্কানি দিতে সহযোগিতা করছে। মালিকের কাছে টাকা আছে ব্যাংক দিতে পারছে না। আরেকটা হলো ডলার রেট ১০০ থেকে ১২০ টাকা হয়ে গেছে। আগে যদি ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা লিমিট দিয়ে থাকে এখন তো ব্যাংক ১২০ কোটি টাকা লিমিট হতে হবে। এখন ব্যাংক ১০০ কোটির বেশি লিমিট দিচ্ছে না। ডলার অনুযায়ীও লিমিট দিচ্ছে না। গার্মেন্ট ব্যবসাটা হলো খুব কম লাভের ব্যবসা। কোনো কারখানা যদি ১৫ থেকে ২০ দিন বন্ধ থাকে তাহলে সেটি ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুরবস্থায় পড়াও অর্থনৈতিক সংকটের কারণ। সব কিছুর মূলেও অর্থনীতি। ফলে ব্যাংকিং সমস্যাটাও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার বিষয়ে কিছুটা ভূমিকা রাখছে।