নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, দেশের জন্য কাজ করার দায়বোধ থেকে নতুন দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দেশকে ভালো কিছু দিতে চাই। শনিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় এ এম এম নাসির উদ্দীন সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তুহিন ভূঁইয়া। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত-
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আলোচিত ও অতীতে বহুলবিতর্কিত সাংবিধানিক পদে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। মিশনটা কতটা চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন?
এ এম এম নাসির উদ্দীন : অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে পড়েছে। এটি আমি চেয়ে নিইনি। মহান আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে এসেছে। আমি এটাকে একটি অপরচুনিটি হিসেবে নিচ্ছি। এখন বাংলাদেশের যে অবস্থা, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা প্রায়ই বলেন-একটা সুযোগ এসেছে। আমি এটাকে সে সুযোগেরই একটা অংশ মনে করি। যেহেতু আমি এ দেশেরই সন্তান, এখানে বড় হয়েছি, পড়াশোনা করেছি, এখানে চাকরিবাকরি করেছি, আমার একটা দায়িত্ব আছে তো। এ দায়িত্ব যখন পড়েছে, আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। সুযোগের একটা সদ্ব্যবহার করা, দেশকে কিছু একটা দেওয়ার জন্যই দায়িত্ব নিয়েছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : গত দেড় দশকে একের পর এক একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে নির্বাচনব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারিয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে করণীয় সম্পর্কে কী ভাবছেন?
এ এম এম নাসির উদ্দীন : দেখেন আস্থা হারিয়েছে কেন, আগে এর কারণে যেতে হবে। মানুষ মনে করেছে আগের তিনটি নির্বাচন কমিশন কাজ করেছে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে। এমন ধারণা মানুষের মাঝে জন্মেছিল। যার কারণে উনারা (নির্বাচন কমিশন) যখন কোনো সভা ডাকত, অনেক দল কিন্তু সেখানে যেত না। কারণ তারা মনে করত, যাওয়া-না যাওয়া একই কথা। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশনটা সে রকম না। আগে তো পিক অ্যান্ড চুজ করে একজনকে মেম্বার বানিয়ে দিত, চেয়ারম্যান বানিয়ে দিত। যিনি দলীয় পারপাস সার্ভ করবেন। সে রকম করে চুজ করেছে। কিন্তু এখন টু এ ভেরি ট্রান্সপারেন্ট প্রসেসে বাছাই করে নির্বাচন কমিশনটা করা হয়েছে। এখানে আগের মতো বিষয়টা নেই যে, সরকার বলবে আমার দলকে জিতিয়ে দাও, আমার দলকে জেতাতে কাজ করো। এখন তো সে রকম নেই। এটা হলো একটা অন্তর্বর্তী সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এটা জাতির সামনে একাধিকবার পরিষ্কার করেছেন। উনার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। উনি একটা সুন্দর-স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করে মুক্তি পেতে চান। এ কথাই উনি বলেছেন। তাঁর ওই এজেন্ডাটা যেন বাস্তবায়ন হয়, তাঁকে সাহায্য করার জন্য আমরা প্রস্তুত।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনার প্রথম কাজ ও পরিকল্পনা জানতে চাই...
এ এম এম নাসির উদ্দীন : শপথ হওয়ার পর দায়িত্ব নিয়ে আগে আমার কাজকর্মটা বুঝতে হবে। তবে একটা সুযোগ আছে। আরেকটা সুবিধা হলো, বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কাজ শুরু করেছে। উনি তো বিশেষজ্ঞ মানুষ, নির্বাচন নিয়ে পড়ে আছেন বহু বছর যাবৎ। উনারা যে সংস্কার কমিশন থেকে কাজ শুরু করেছেন, উনারাই আমাদের অনেক সুপারিশ দেবেন, আমরা এটা পড়লেই বুঝব কোথায় কোথায় আমাদের সংস্কার করতে হবে, অনেক জিনিস আমরা রেডি পেয়ে যাব। যেটা আমাদের গবেষণা করে, খুঁজে খুঁজে বের করতে হতো। এটা আমাদের জন্য সুবিধা। আরেকটা অ্যাডভান্টেজ হলো, এখন কিন্তু রাজনৈতিক দল যারা নির্বাচন করবে তারা ১৫-১৬ বছর ধরে বলে আসছে, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দে আর কমিটেড টু দ্য ন্যাশন। তাদের যুদ্ধ, তাদের আন্দোলন, তাদের লড়াই সব মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য-এ কথা তারা বলে আসছে। এটা তো বিরাট অ্যাডভান্টেজ আমাদের জন্য। আমরা বলতে চাই-এতদিন তোমরা যা বলে এসেছ, আমরা তোমাদের সাহায্য করতে চাই। আমাদের সঙ্গে আসো। এ সুযোটা তো আগে ছিল না। প্রতিটি দল তাদের কমিটমেন্ট দিয়েছে জাতির কাছে, আমরা এটা রিয়েলাইজ করে তাদের সঙ্গে নিয়ে সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারব, ফ্রি, ফেয়ার ও ক্রেডিটেবল নির্বাচন করতে পারব ইনশাল্লাহ।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচনের জন্য যদি চাপ আসে কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
এ এম এম নাসির উদ্দীন : চাপ কোথা থেকে আসবে? চাপটা আসে কখন জানেন-যদি দেখে চাপে আপনি এদিকে একবার হেলবেন, ওদিকে একবার হেলবেন তাহলে চাপ আসবে। যদি দেখেন আপনি হেলবেন না, আপনি সিরাতুল মুস্তাকিমের মতো থাকবেন। ইউ উইল স্টিক টু ইউর প্রিন্সিপল। তাহলে কিন্তু যারা চাপ দিতে চায়, তারা জানে, উনি তো নড়বেন না। আমার চাকরি জীবনের ৩২ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। তিনটি মন্ত্রণালয় চালিয়েছি আমি। যিনি চাপের কাছ নতি স্বীকার করেন, তার কাছে চাপ আসতেই থাকে। আর যিনি স্বীকার করবেন না তার কাছে কোনো চাপ আসবে না। আমি তো জাতির কাছে কমিটমেন্ট দিয়েছি, রাজনৈতিক দলগুলো যেমন দিয়েছে। আমিও তাতে বিশ্বাস করি। একটা ফ্রি-ফেয়ার ক্রেডিটেবল ইলেকশন দেওয়ার জন্য। সুতরাং চাপ দিলে বলব, আপনারা তো জাতির কাছে এ ওয়াদা করেছিলেন, তো এখন আবার এ ধরনের কথা বলছেন কেন! আমি বিশ্বাস করি, এ রকম চাপ আসবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিতর্কিত নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত ইসি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না?
এ এম এম নাসির উদ্দীন : কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। চিনিও না। এখন তারা কে বিতর্কিত, কে বিতর্কিত নন, কে ভালো, কে খারাপ কোনো ধারণা নেই। আগে আমাকে বসতে দিন। কাজের মাধ্যমে বুঝব। আমি প্রি-কনসেপ্ট আইডিয়া নিয়ে জীবনে কোনো দিন কোনো কাজ করিনি। এ অফিসের লোকগুলো, এ খারাপ ও ভালো, এ মন্দ-এভাবে একটি প্রিকনসেপ্ট আইডিয়া নিয়ে আমি শুরু করি না। কাজের মাধ্যমে আমি বুঝতে পারব আসলে সে ভালো কি খারাপ। এর জন্য একটা প্রিকনসেপ্ট আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করতে চাই না। আমি মনে করি যে অফিসারগুলোকে আপনারা গালি দিচ্ছেন, ওরাই তো ভালো নির্বাচন করে দেখিয়েছে দেশে জাস্টিস সাহাবুদ্দীনের আমলে। ওই পুলিশই করেছে, ওই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন করেছে। আপনি যদি চালাতে জানেন, ওরা যদি বোঝে যে, উনার নিয়ত সহি, তাহলে ওরাও সহি নিয়তে কাজ করবে। আর ওরা যদি বোঝে, উনি একটা দলকে জেতাতে চান। তাহলে নিজেরদের ওই দিকে লাইন ধরাবে। আমাদের যেহেতু নিয়ত পরিষ্কার, আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার সুতরাং ওরাও বুঝবে এরা তো ভালো কাজ করছে। ওরা আমাদের সহযোগিতা করবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : কোন পদ্ধতির নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আপনি মনে করেন?
এ এম এম নাসির উদ্দীন : পৃথিবীর বহু দেশে বহু নির্বাচন পদ্ধতি আছে। এটা নিয়ে নানা বিষয় পত্রপত্রিকায় দেখছি। আমাদের সংবিধান সংস্কারের জন্য কাজ করছেন আন্ডার দি ভেরি এভেল লিডারশিপ কমপ্রিহেনসিভ পারসন ড. আলী রীয়াজ। বিশ্বব্যাপী উনার সুনাম আছে। উনার সঙ্গে আরও অন্য বিশেষজ্ঞরা ওখানে আছেন, তাঁরা এসব বিষয় খুঁটিনাটি যাচাইবাছাই করে সব বিষয় দেয়ার উইল রিকমান্ড। কারণ এটা তো আলটিমেটলি সংবিধানে থাকতে হবে। সংবিধান সংস্কার কমিটি যা করবে, যে সুপারিশগুলো গ্রহণ করে, সংবিধানে যেভাবে নির্বাচন করতে বলে আমরা সেভাবেই করব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিয়ে আপনার পরিকল্পনা জানতে চাই...
প্রধান নির্বাচন কমিশনার : আমরা তো সবাইকে আনতে চাই। সবাই একটা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন চায়। সেভাবে আমরা একটা পরিবেশ তৈরি করব। এখানে আগের যে সরকার, আগের যে জোট এ নিয়ে একটা বিতর্ক চলছে। তাদের থাকা উচিত কি উচিত না, এ নিয়ে বিশাল একটা বিতর্ক আছে। এ বিতর্কটার ফয়সালা হোক। এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা আমি আমার জন্য প্রিম্যাচিউরড্ মনে করি। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।