বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, দেশ থেকে পালানোর ইতিহাস আওয়ামী লীগের নতুন নয়। পতিত স্বৈরাচারী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা কিংবা তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরাই প্রথম পালিয়ে যাননি। ১৯৭১ সাল থেকেই সেটা শুরু হয়েছে।
১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর আসাদ গেট এলাকার বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যখন জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে যুদ্ধ করছি, তখনো দেখেছি আওয়ামী লীগের ‘টপ টু বটম’ নেতারা ভারতের কলকাতায় গিয়ে হোটেলে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করেছেন। সেখানে গিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছেন। কয়েক দিন আগেও আমরা দেখেছি, ভারতের শিলংয়ে গিয়ে ধর্ষণের দায়ে ছয়জন আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। একই সময়ে কলকাতা ‘রেডলাইট এরিয়া’তেও কয়েকজন একই অপরাধে ধরা পড়েছেন। এরা দেশের ভিতরে থাকতে যেমন গুরুতর অপরাধ করে গেছেন, পালিয়ে বিদেশে গিয়েও একই ধরনের আপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন। শেখ হাসিনাসহ এই অপরাধীদের গণহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে আইন অনুযায়ী যথাযথ বিচারের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় দেশে বিচার বলে কিছুই থাকবে না।
অন্তর্বর্তী সরকার ও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার রাজনৈতিক সরকার নয়। রাজনৈতিক পলিসিসম্পন্ন সরকার ছাড়া রাষ্ট্র তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা যেন যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে জনগণের সরকার উপহার দেয়। তিনি বলেন, আপাতত নির্বাচনের তারিখসহ একটা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায় জনগণ। এতে তারা তাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার কবে নাগাদ পাবে সে সম্পর্কে একটা পরিষ্কার চিত্র পেয়ে যাবে।
সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত নিচে দেওয়া হলো-
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : বিভিন্ন দিকে দৃষ্টি না দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম জনগণের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেত। খুনি হাসিনার আমলে পরপর চারটি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারে নাই। জনগণের ভিতর এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের চার মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তাদের দায়িত্ব ছিল একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে শাসনভার অর্পণের জন্য যা যা করণীয় তা সম্পন্ন করা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে যে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ‘মাইনাস টু’র ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : এটা কল্পকাহিনি। তারেক রহমান দেশে ফিরবেন এবং দেশের মানুষের নেতৃত্ব দেবেন। কারণ তিনি এখন শুধু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনই নয়, সারা বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে জনপ্রিয় নেতা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয় বলে মনে করেন।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : যত দ্রুত সম্ভব করা যায় ততই ভালো। কথায় আছে, যার তিন মাসে হয় না তার নয় বছরেও হবে না। নির্বাচনটা কবে হবে, এটা জানার অধিকার মানুষের আছে। তাই জনগণকে ধোঁয়াশার মধ্যে না রেখে নির্বাচনি রোডম্যাপটা অবিলম্বে দিয়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে কীভাবে দেখছেন? বিএনপি কোন কোন সংস্কারের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : দেশের এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে সরকারের দু-একটা সংস্কারের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করি। পুলিশ প্রশাসন এখনো কার্যকর হয়নি। যারা শেখ হাসিনাকে দানব বানিয়েছিল, প্রশাসনে আওয়ামী লীগের সেই দোসররা এখনো রয়ে গেছে। সুতরাং প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলার প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচনের পর বিএনপি জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : পূর্বঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে বিএনপি ওয়াদাবদ্ধ। ৩১ দফায় বলা আছে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁদের সবার অংশীদারির ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠন করে দেশের কার্যক্রম পরিচালনা করব। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বিএনপি অঙ্গীকারবদ্ধ।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ইতোমধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের অংশ নিতে না দেওয়ার দাবি উঠছে। জুলাই-আগস্টের গণহত্যার জন্য তাদের বিচারের দাবিও জোরালো হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : আওয়ামী লীগ জুলাই-আগস্টে যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে তার বিচার না হলে দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের কোনো বিশ্বাসই থাকবে না। সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আর পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর জনগণ দিয়ে দিয়েছে। হারিকেন দিয়ে খুঁজেও মোমবাতি জ্বালানোর জন্য আওয়ামী লীগের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের মানুষের কাছে পাত্তা না পেয়ে এখন আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে বিদেশের মাটিতে নির্বাসিত ভার্চুয়াল দল। নির্বাচনের মাঠে নামলে মানুষের কাছে গণপিটুনি খাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাই তারা এখন প্রায় নিখোঁজ একটি দল।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচন নিয়ে বিএনপির প্রস্তুতি কেমন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : প্রস্তুতি আছে বলেই বিএনপি নির্বাচন চাইছে। বিএনপিতে প্রার্থীর অভাব নেই। কাকে রেখে কাকে দেব, এটা নিয়েই মধুর সমস্যা তৈরি হবে। গত ১৬ বছর শেখ হাসিনা সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে যাঁরা টিকে ছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে একজন মাত্র প্রার্থী বাছাই করা খুবই কঠিন কাজ। তবে দল পুরোপুরিই প্রস্তুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : স্থানীয় নাকি জাতীয়, কোন নির্বাচন আগে হওয়া উচিত?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : প্রথমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। এরপর নির্বাচিত সংসদ নির্ধারণ করবে তারা কবে, কীভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়। কারণ প্রথমেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া মানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সংবিধান সংস্কার বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। যদিও আদালত ইতোমধ্যেই আংশিকভাবে তা বাতিলের রায় দিয়েছে। এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তারপরও বলব, সংবিধান সংস্কার করতে হবে। তবে সংবিধান সংস্কার করতে হলে নির্বাচিত সংসদ লাগবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কীভাবে দেখেন। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অবদান কতটুকু?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : বিএনপি দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েছে। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছে। বহু কর্মী ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন। আমার স্ত্রীও আহত হয়েছেন। তাঁর শরীরে এখানো বুলেট রয়ে গেছে। আন্দোলনের উত্থানপতন ছিল। কিন্তু জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পুরো ক্ষেত্রটা তৈরি করেছে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দল। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনেও সবচেয়ে বেশি জীবন দিয়েছেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা। ফাইনাল স্টেজে ছাত্র-জনতা মাঠে নেমে সবার সহযোগিতায় বিজয়ের গোলটা দিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলছেন, আগামী সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জিং। চ্যালেঞ্জগুলো কী?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : আমাদের মূল যুদ্ধ নির্বাচন। জনগণের আস্থা ধরে রেখে তাদের রায় নিয়ে দেশ পরিচালনার অংশ হতে হবে। তা ছাড়া অনেক ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত চলছে যেগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল কবে নাগাদ হতে পারে?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলো পুনর্গঠনের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এগুলো শেষ হলেই জাতীয় কাউন্সিলের আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণকে কীভাবে দেখছেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা বন্ধুসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করি। কিন্তু ভারত যদি বাংলাদেশের জনগণকে বাদ দিয়ে শুধু শেখ হাসিনা প্রীতি দেখায়, উসকানি দিয়ে সাম্প্রতিক দাঙ্গা বাঁধাতে চায় এবং মিথ্যাচার করে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে চায় তবে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। ভারতকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক। ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের ভোট বাড়ে, কিন্তু বাংলাদেশে কট্টর ইসলামপন্থিদের ভোট কমে। শেখ হাসিনা ভারতে বসে সংখ্যালঘু কার্ড খেলার চেষ্টা করছেন। তিনি বোঝাতে চাইছেন, আওয়ামী লীগ না থাকলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদের উত্থান ঘটে এবং হিন্দুরা সহিংসতার শিকার হয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাকে ধন্যবাদ।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : আপনাদেরও ধন্যবাদ।