সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে রাজধানীর মহাখালীতে রেলপথ অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। অন্তত ১৭টি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়। গতকাল বিকাল পৌনে ৪টায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন লাল পতাকা দেখিয়ে আটকে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ অবরোধ শুরু হয়।
দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা পর ঢাকা-টঙ্গী-ঢাকা সেকশনে শুরু হয়েছে ট্রেন চলাচল। আগামী সাত দিনের মধ্যে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় ইস্যুতে সরকার পদক্ষেপ নেবে, এমন আশ্বাসে আমরণ অনশন ভেঙেছেন কলেজটির শিক্ষার্থীরা। এর পরই তাঁরা আটকে রাখা রাজধানীর মহাখালী রেলপথ থেকে সরে আসেন। গত রাত ১০টার দিকে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, বিকাল ৩টা ৪০ মিনিট থেকে রাত ৯টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। রাত ৯টা ৫০ মিনিটে প্রথম ট্রেন হিসেবে রাজশাহীর উদ্দেশে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস (৭৫৩) ঢাকা স্টেশন ছেড়ে গেছে। তবে রাত সাড়ে ৮টার দিকে কমলাপুর স্টেশনে আটকে পড়া যাত্রীরা স্টেশন ম্যানেজার মো. শাহাদাত হোসেনকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। রাত ৯টার দিকে বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের নিশ্চিত করেছিলেন খোদ কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার। তিনি বলেছিলেন, মহাখালীতে রেললাইন অবরোধ করার পর রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত কমলাপুর থেকে ১৬টি ট্রেন যেতে পারেনি। অনেক যাত্রী স্টেশনে আটকা পড়েন। তাঁরা আমাদের কাছে জানতে চান কখন ট্রেন ছাড়বেন। বিষয়টিতে আমরা খুব ঝামেলায় ছিলাম। কারণ বিকাল ৪টার দিকে তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের রেলপথ অবরোধে টঙ্গী জংশন হয়ে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দর স্টেশনে আটকে থাকা এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেন ৯টা ৫০ মিনিটে ঢাকা স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। তেজগাঁও স্টেশনে আটকে থাকা নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস ৯টা ৫০ মিনিটের পর বিমানবন্দর স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা করে।
কমলাপুরে যাত্রীদের হাঙ্গামার সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তিতুমীর শিক্ষার্থীদের আলোচনা চলছিল। পরে মন্ত্রণালয়ের একগুচ্ছ আশ্বাসে রাত সাড়ে ৯টার দিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন সাত দিনের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন।
আন্দোলন স্থগিত : আন্দোলন সাত দিনের জন্য স্থগিত করেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পক্ষে লায়েক নুর মোহাম্মদ গতকাল রাত ১০টার দিকে এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আগামী সাত দিনের মধ্যে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় ইস্যুতে সরকারের স্পষ্ট নীতি ঘোষণা করা হবে’ এমন আশ্বাসে সব ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
এর আগে রাত পৌনে ১০টার দিকে মহাখালী রেলক্রসিং এলাকায় যান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. নুরুজ্জামান। তিনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতির দাবি বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত সরকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি কলেজের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। পরে তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী লায়েক নুর মোহাম্মদ বলেন, অন্তর্র্বর্তী সরকার এই মুহূর্তে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমাদের অনুরোধ করেছেন। কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দিলে অন্য কলেজগুলোও আন্দোলনে নেমে যাবে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের জন্য কঠিন হবে। তাই আমরা নির্বাচিত সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করব।’ কলেজ কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে জানিয়ে লায়েক নুর মোহাম্মদ বলেন, এ কমিটি ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম ও কলেজ পরিচালনা করবে। আমরা কি এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে সবাই একমত, প্রশ্ন করে সবার মতামত চান তিনি। পরে শিক্ষার্থীরা ‘হ্যাঁ’ বলে সাড়া দেন। এর পর অনশনরত শিক্ষার্থীদের জুস খাইয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়।
ব্যাপক ভোগান্তি : তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মহাখালী আমতলী মোড় ও রেলগেট এলাকায় বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থান নিতে দেখা গেছে। একই সঙ্গে পাশেই পুলিশের একটি জলকামানও প্রস্তুত ছিল। এর আগে রবিবার রাতে রেলপথ ও মহাসড়কে সর্বাত্মক অবরোধ এবং কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে গতকাল সকাল থেকে কলেজের প্রধান ফটকে জড়ো হন তারা। দুপুরে শিক্ষার্থীরা গুলশান-মহাখালী সড়কে বাঁশ ফেলে অবরোধ শুরু করেন। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।
বিকালে কলেজের মূল ফটকের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে মহাখালী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দিকে যান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘তিতুমীর আসছে, রাজপথ কাঁপছে’, ‘টিসি না টিউই, টিউই টিউই’, ‘আমার ভাই অনশনে, প্রশাসন কী করে’, ‘প্রশাসনের সিন্ডিকেট, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য, চলবে না চলবে না’, ‘অধ্যক্ষের সিন্ডিকেট, মানি না মানব না’, ‘আমাদের সংগ্রাম, চলছে চলবে’ ইত্যাদি বিভিন্ন স্লোগান ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে মহাখালী রেলক্রসিং অবরোধ করেন। লাল পতাকা দেখিয়ে নোয়াখালী অভিমুখী উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন থামিয়ে দেওয়া হয়। আটকে যাওয়া ট্রেনটির লোকোমাস্টার আবদুল লতিফ বলেন, উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৩টা ২৫ মিনিটে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে আসে। আমার ট্রেনের গতিসীমা ছিল ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। রেলগেটে দূর থেকেই লাল পতাকা ও মানুষের জটলা দেখতে পাই। পরে ট্রেনটি দ্রুত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গতি কমিয়ে থামাতে সক্ষম হই। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। পরে বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটে ট্রেনটি উল্টোদিকেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, বিকাল ৫টায় রেল লাইনের ওপর বসে ছিলেন ২০-৩০ জন শিক্ষার্থী, দাঁড়িয়ে ছিলেন অর্ধ শতাধিক। তাদের চারপাশ ঘিরে পুলিশ, ডিবি, বিজিবি এবং এপিবিএন সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। এদের পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় জল কামান। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে ১৭টি ট্রেন ঢাকা থেকে ছাড়তে বিলম্ব হয়।
ট্রেনগুলোর মধ্যে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, যমুনা এক্সপ্রেস, চিলাহাটি এক্সপ্রেস, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস, এগারসিন্ধুর গোধূলি, চিত্রা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, হাওর এক্সপ্রেস, কক্সবাজার এক্সপ্রেস, পদ্মা এক্সপ্রেস, তূর্ণা এক্সপ্রেস এবং পঞ্চগড় এক্সপ্রেস। সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে বেশ কয়েকমাস ধরে আন্দোলন করে আসছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে মিছিল, সড়ক-রেলপথ অবরোধ, স্মারকলিপি প্রদান, ক্লাস বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো সাড়া না পেয়ে বুধবার বিকাল থেকে দাবি আদায়ে আমরণ অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।