রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের একটি রূপরেখা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি জানিয়েছে, নির্বাচন যে কোনো সময় হতে পারে। তবে তার আগে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে। গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ইসিকে দায়বদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি। গতকাল জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে এ সংস্কার প্রস্তাব হস্তান্তর করে এনসিপি। আখতার হোসেনের নেতৃত্বে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার, জাভেদ রাসিন, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম এতে অংশ নেন। এর আগে ১৯ এপ্রিল সংলাপে অংশ নেয় দলটি। সেদিন আলোচনার পর তা মুলতবি হয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে আরও উপস্থিত আছেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। এনসিপির দেওয়া মৌলিক সংস্কারের রূপরেখায় পাঁচটি বিষয়কে মূল উপাদান হিসেবে বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-শাসনব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী বা স্বৈরাচারী প্রবণতার উপকরণ চিহ্নিত করে তা বিলুপ্ত করা। যেমন এককেন্দ্রিক ক্ষমতা, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ, পক্ষপাতমূলক নির্বাচনব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রিত বিচার বিভাগ ইত্যাদি। গণতান্ত্রিক রীতি ও প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, যেখানে জনগণের ভোট, মতামত ও অংশগ্রহণই হবে নীতিনির্ধারণের মূল ভিত্তি। ক্ষমতার ভারসাম্য ও বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা, যাতে কোনো এক ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠান শাসনব্যবস্থার ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে না পারে। স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করা, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন সংস্থা, মহাহিসাব নিরীক্ষক প্রভৃতি। সাংবিধানিক সুরক্ষা ও সংশোধন প্রক্রিয়ায় জন-অংশগ্রহণ সংযুক্ত করা, যাতে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শাসনব্যবস্থা রক্ষিত থাকে এবং জনগণের অনুমতি ছাড়া তা পরিবর্তন করা না যায়।
মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ১০টি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এনসিপি। এগুলো হচ্ছে-সাংবিধানিক ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সাংবিধানিক পদে নিয়োগ, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার, দুদক সংস্কার, স্থানীয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও জনপ্রশাসন সংস্কার। এ প্রসঙ্গে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘মৌলিক সংস্কার স্রেফ নির্বাচনি সংস্কার নয়; মৌলিক সংস্কার আসনভিত্তিক সংসদীয় দুই-তৃতীয়াংশের জোরে করা সংবিধান সংশোধনও নয়। মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি ও বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত হবে।’ মৌলিক সংস্কারের পাঁচটি লক্ষ্য রয়েছে বলে তিনি জানান। এগুলো হচ্ছে-শাসনব্যবস্থা স্বচ্ছ, বিকেন্দ্রীকরণ এবং অংশগ্রহণমূলক করা। দলীয় আধিপত্য হ্রাস করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নৈতিক শুদ্ধতা বজায় রাখা। জনগণের প্রত্যক্ষ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের বিধান চালু করা এবং তরুণ ও নারীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্তির সুযোগ বাড়ানো।
আখতার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ যেন অতীতের মতো ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতন্ত্র কাঠামোর মধ্যে না থেকে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে নিজেদের শামিল করতে পারে, সে জায়গায় এনসিপির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব হাজির করেছি।’
নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে নয়টি প্রস্তাব : অন্যদিকে জনসংস্কার কমিশনের ক্ষেত্রে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে নয়টি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, ‘সংসদে স্থায়ী কমিটিতে বিরোধী দল থাকতে হবে। আজ আলোচনায় এসেছে সব মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে না হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে মন্ত্রণালয় আছে, সে মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটিতে বিরোধী দল থেকে প্রধান করা হবে।
যেমন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এগুলোর প্রধান যেন বিরোধী দল থেকে হয় সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আমাদের যে মতামত ছিল সেখানে আমরা বলেছি, সরকারের স্থিতিশীলতা এবং সংসদ সদস্যদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথা দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানের অধিকার, এ পক্ষে আমরা অবস্থান নিয়েছি। যে কারণে আমরা বলেছিলাম যে অর্থবিল এবং অনাস্থা ভোট বাদে অন্য যে কোনো বিলে সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন।’ সারোয়ার তুষার বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আওতায় কী কী কাজ করতে পারবে, কী কী ধরনের বিচারিক ক্ষমতা থাকবে, এগুলো নিয়ে আলোচনা এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের অনিয়ম জবাবদিহির আওতায় কীভাবে আনা যাবে, সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত আছে। কমিশন প্রস্তাব করেছে সংসদীয় কমিটির মধ্য দিয়ে একটা তদন্ত করা হবে, অনেক রাজনৈতিক দল মত প্রকাশ করেছে, এতে রাজনীতি করার একটা আশঙ্কা থাকে। অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে এটার সমাধান করা যেতে পারে।’ এনসিপির দেওয়া মৌলিক সংস্কার প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া প্রস্তাবগুলোর পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে মৌলিক সংস্কারের যে রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে তা গ্রহণ করেছি। পর্যালোচনা সাপেক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এ রূপরেখার একটি প্রতিফলন পাওয়া যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিকসহ বিভিন্নভাবে কমিশনের আলোচনা অগ্রসর হচ্ছে। এ অব্যাহত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা, যা গণতান্ত্রিক এবং জবাবদিহিমূলক ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথরেখা নির্দেশ করবে।’
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ১৫ মে’র মধ্যে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করার চেষ্টা করছি। তারপর দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করতে চায় কমিশন।’