বিচারের আগ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো। এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ায় অবিলম্বে দল হিসেবেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন তারা। বলেছেন বিচারের দাবিতে রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার কথাও।
বিএনপি : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা আনন্দিত যে, বিলম্বে হলেও অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গে যুক্ত সব সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল দলের পক্ষে সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব এ কথা বলেন। শনিবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত জানাতে এ বিবৃতি দেওয়া হয়। মির্জা ফখরুল বলেন, গত ১০ ফেব্রুয়ারি আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তার হাতে দেওয়া পত্রে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ দায়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছিলাম। ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাৎকালেও তার হাতে দেওয়া পত্রে আমরা পতিত ফ্যাসিবাদী দল ও সেই দলীয় সরকারের সঙ্গে যারাই যুক্ত ছিল তাদের বিচার দ্রুত করে দেশের রাজনীতির ময়দানকে জঞ্জালমুক্ত করার দাবি জানিয়েছি। আলোচনায় আমরা স্পষ্ট করে বলেছিলাম যে, আইনি প্রক্রিয়াতেই ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব ও উচিত। বিভিন্ন সভা, সমাবেশে ও আলোচনায় আমরা আমাদের এসব দাবি বারবার উত্থাপন করেছি। উল্লেখ্য, আমরা প্রশাসনিক আদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে বলেই বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের আগ মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।
জামায়াতে ইসলামী : জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দাবির আংশিক পূরণ হয়েছে। তবে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। জুলাই প্রোক্লেমেশন এখনো আসেনি। বিপ্লবের পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা এখনো পাইনি। তবে আমাদের ধৈর্যের সঙ্গে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে। শনিবার মধ্যরাতে রাজধানীর মগবাজার চৌরাস্তায় অনুষ্ঠিত এক পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ পথসভা অনুষ্ঠিত হয়।
জামায়াত আমির বলেন, আমরা জুলাইকে কোনোভাবেই হারিয়ে যেতে দেব না বরং তা দেশ, জাতি, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথাযথভাবে কাজে লাগাব। আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা শহীদ পরিবারের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছি। তারা সরকারের কাছে কোনো আর্থিক সহযোগিতা চায় না বরং তারা দ্রুততার সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ তার দোসরদের বিচার চায়। তারা আশা করে-বর্তমান বিপ্লবী সরকার জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে যৌক্তিক সব দাবি পূরণ করবে।
গণসংহতি আন্দোলন : ‘নির্বিচার হত্যার দায়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার’ দাবিতে গতকাল পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ স্থগিত করেছে গণসংহতি আন্দোলন। দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা বিচারিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। নেতৃবৃন্দ বলেন, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডসহ ১৫ বছরের গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, অর্থ পাচার ইত্যাদি অপকর্মের বিচারের দাবিতে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
হেফাজতে ইসলাম : হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা, শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচারের আওতায় আনা এবং বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির সব কার্যক্রম বন্ধ রাখার দাবিতে আমরা আন্দোলন করেছি। আজ সেই তিন দফা দাবির একটি পূরণ হয়েছে। এজন্য শুকরিয়া আদায় করছি। শনিবার দিবাগত রাত ৩টায় শাহবাগে তিনি এসব কথা বলেন। মামুনুল হক বলেন, এ আন্দোলন এখানেই শেষ নয়, বরং বিচার কার্যক্রমের দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। আমরা নির্বাচন চাই। তবে তার আগে বিচার কার্যক্রমের দৃশ্যমান অগ্রগতি হতে হবে। শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের বিচারিক কার্যক্রমের অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত দেশে নির্বাচনের প্যাঁচাল শুনতে চাই না।
জেএসডি : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, গণহত্যার বিচার সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ জড়িত এবং গতিপথ নির্ধারিত হবে। এটি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী কৃতকর্মের নৈতিক পরীক্ষা- যা ন্যায়বিচার, মানবিকতা এবং গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার এক অগ্নিপরীক্ষা। তবে রাষ্ট্রকে অবশ্যই অভিযুক্ত হিসেবে আওয়ামী লীগের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। শনিবার রাজধানীর উত্তরার বাসভবনে অনুষ্ঠিত জেএসডির স্থায়ী কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। গতকাল দলের দপ্তর সম্পাদক কামরুল আহসান অপু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। সভার রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়- গণহত্যা মানবতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ অপরাধ। যখন কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ওঠে এবং সেই অভিযোগ একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন হয়, তখন রাষ্ট্রের প্রধান নৈতিক কর্তব্য হয়- বিচার প্রক্রিয়াকে স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত রাখা, অভিযুক্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
খেলাফত মজলিস : ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে খেলাফত মজলিস। গতকাল দলটির আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতা-কর্মী মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এসব অপরাধীর মধ্যে এখনো অনুতাপের লেশমাত্র নেই। আমরা সরকারকে অবিলম্বে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার ও নিবন্ধন বাতিল এবং তাদের অপরাধী নেতা-কর্মীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করার দাবি জানাচ্ছি।
ওয়ার্কার্স পার্টি : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি যতটা না আইনগত তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বিষয়। সে কারণে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয় রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের মধ্যে মতৈক্য প্রয়োজন। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগসংক্রান্ত সংকটের সমাধান মিলবে না। সরকার পরিবর্তন হলে এ সিদ্ধান্ত উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ব্যক্তিগত এবং দলগত দুই পদ্ধতিতেই আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সাংগঠনিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন ও অকার্যকর করে তোলাটাই বেশি জরুরি।
বাসদ : সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। দলটি বলছে, এ ধরনের সিদ্ধান্তে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সহানুভূতি তৈরি করতে পারে। গতকাল এক বিবৃতিতে বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমন আইন বা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো অগণতান্ত্রিক আইনের মাধ্যমে নির্বাহী আদেশে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে জুলাই গণহত্যাসহ সব অপরাধের বিচারের মাধ্যমে সঠিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত।